প্রকাশ: রোববার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০, ২:০৯ পিএম আপডেট: ২৯.১১.২০২০ ৩:১৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
গত কয়েকদিনে কৃষক বিদ্রোহে অনেকটাই টালমাটাল হয়ে পড়েছে ভারত। লাখ লাখ কৃষক তাদের তিন দফা দাবি আদায়ে জমায়েত হয়েছেন দিল্লিতে। নতুন কৃষি সংস্কার বিল বাতিলের দাবিতে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে লাখ লাখ কৃষক রাজধানী দিল্লি অভিমুখে গত শুক্রবারই এসে পৌঁছেছেন। কৃষকদের দাবির পক্ষে ইতোমধ্যে সংহতি প্রকাশ করেছে বিজিপি বিরোধী সব দল। ফলে কৃষকবিদ্রোহ নিয়ে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ ঘটতে পারে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। যদি কোনোভাবে মোদি সরকার এ কৃষকবিদ্রোহ দমনে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করেন তবে ভারতের রাজনীতির মোড়ও ঘুরে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কৃষকরা তাদের দাবির পক্ষে অনড় এখনো। পথে পথে পুলিশের লাঠিপেটা, জলকামান উপেক্ষা করে এমন অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক আন্দোলন ভারতের রাজনীতিই নয় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের দিচ্ছে রাজনীতিতে নতুন বার্তা।
আন্দোলনরত ভারতের কৃষকদের দাবি সম্প্রতি পার্লামেন্টে নতুন উত্থাপিত বিলগুলো তাদের স্বার্থ বিরোধী। গত সেপ্টেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে তিনটি কৃষিসংস্কার বিল পাশ হয়। যার প্রথমটিতে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি কৃষিবাজারগুলো কার্যত বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিলটি ফসলের আগ থেকে ঠিক করে রাখা দামে চুক্তিভিত্তিক চাষ বা কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পথ প্রশস্ত করবে। আর ব্যবসায়ী বা উৎপাদকরা কতটা ফসল মজুদ করতে পারবেন তার উপর সরকারি যে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বর্তমান আছে তৃতীয় বিলে সেটা বিলোপ হয়ে যাবে। কৃষকদের দাবি, নতুন এই বিলগুলো তাদের স্বার্থবিরোধী। কারণ, নতুন বিলে প্রাইভেট ফার্মগুলো কৃষিখাতে চালকের ভূমিকায় চলে যাবে। কৃষকদের হাতে আর কিছুই থাকবে না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষকরা বলছেন, যতদিন পর্যন্ত সরকার ওই তিনটি কৃষিসংস্কার বিল বাতিল না করবে ততদিন পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
প্রথমে পাঞ্জাব থেকে তাদের যাত্রা শুরুর পর বৃহস্পতিবার প্রতিবেশী হরিয়ানা রাজ্যে পৌঁছে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন কৃষকরা। সারাদিন ধরেই হরিয়ানা পুলিশ বিভিন্ন ভাবে বিক্ষোভরত কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। বেলা যত গড়াতে থাকে পুলিশের বাধা বাড়তে থাকে। আর কৃষকরাও তত আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠেন। এসময় পুলিশ কৃষকদের উপরে চড়াও হয়। পুলিশী অ্যাকশানে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রাত ১১টার দিকে হরিয়ানার সোনপতে প্রবল ঠা-ার মধ্যে পুলিশ কৃষকদের বিরুদ্ধে জলকামান ব্যবহার করে বলে জানায় কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার। এসময় বিদ্রোহীদের পরণে পরিধেয় কাপড় ছাড়া অন্যকিছু দেখা যায়নি। প্রচ- শীতকে উপেক্ষা করে কৃষকদের এই স্ততঃস্ফূর্ততা ভারতবাসীর নজর কেড়েছে। কৃষকদের এই আন্দোলনের সংহতি প্রকাশ করেছে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল কড়া পুলিশি পাহারার মধ্যেই বিক্ষোভ করতে দিল্লির বুরারি মাঠে জমায়েত হয়েছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা। বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, ওই মাঠে তারা ততক্ষণ অবস্থান করবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের কথা সরকার শোনে। ওই এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদিকে কৃষকদের দিল্লি চলো অভিযান চলার মধ্যেই গত শুক্রবার উড়িষ্যার বিধানসভার সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তিন কৃষক। গত সেপ্টেম্বরে ভারতে নতুন কৃষি আইন পাস হওয়ার পর থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন দেশটির কৃষকরা। ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি তারা আন্দোলন সংগ্রামের পথে হাটতে থাকেন। কৃষকদের এই আন্দোলনে সরকার সাড়া না দেওয়ায় কৃষকদের ভিতরে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক অসন্তোষ প্রকাশে কৃষকরা দিল্লি অভিমুখে লংমার্চ শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। গত তিন দিন ধরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের লাখ লাখ কৃষক রাজধানী দিল্লির দিকে অগ্রসর হয়ে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছান। প্রথম দিকে সরকারিভাবে এই আন্দোলন প্রতিহত করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। এসময় দিল্লি ঢোকার সব রাস্তা বন্ধ করে সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়। কৃষকদের ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে নিরাপত্তা অনেক বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে সেখানে মেট্রো চলাচল ব্যবস্থাও বিঘিœত হচ্ছে। এদিকে বিক্ষোভরত কৃষকদের আটকাতে প্রশাসন শক্ত অবস্থান নেয়। দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে নিরাপত্তা নজরদারির জন্য ড্রোন ক্যামেরা মোতায়েন করা হয়। বলা যেতে পারে সারা দেশ থেকে দিল্লিকে বিছিন্ন করার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
এসময় কৃষকদের ঠেকাতে সরকারের সঙ্গে বিজেপি সমর্থক কর্মীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। ফলে কৃষকদের দিল্লি ঢোকার সব করিডর বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই আন্দোলনরত কৃষকরা যেখানে বাধা সেখানেই অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত প্রদেশেগুলোতে আন্দোলন কারীরা বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কোনভাবেই সিদ্ধান্ত বদল না করে তারা তাদের কর্মসূচিতে অনড় থাকেন। স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, এই অবস্থার প্রেক্ষিতে মোদি সরকার অনেকটাই নমনীয় হয়ে তাদের সঙ্গে আপস রফার চেষ্টা করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা দিল্লি প্রবেশের বিষয়ে কোন ছাড় দিতে রাজী না হলে তাদেরকে সীমিত আকারে দিল্লি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এসময় তাদেরকে নিদিষ্ট স্থানে জমায়েতের জন্য পুলিশ সম্মতি দেয়। এই সম্মতি পাওয়ার আগে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কয়েক দফায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষও হয়। এরপর গত শুক্রবার বিক্ষোভকারীদেরকে দিল্লিতে প্রবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। তবে তাদের জন্য দিল্লির বুরারি এলাকার নিরঙ্কারী মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এসময় পুলিশ তাদেরকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার ছাড়পত্র দেয়। এমনকি সেখানে বিক্ষোভের জন্য ব্যবস্থা করে দেয় পুলিশ। পরে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিরঙ্কারী মাঠ পরিদর্শন করেন বিক্ষোভকারী কৃষকদের প্রতিনিধিরা। মাঠে সবধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যেটাকে আন্দোলনকারীরা অনেকটাই সন্দেহের চোখে দেখছেন। এদিকে পরিস্থিতি তত্ত্বাবধানে বিক্ষোভস্থল পরিদর্শন করেছেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যরাও। চলমান কৃষক আন্দোলনে একে একে যোগ দেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশের কৃষকরা। এদিকে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন ঘিরে চরম উত্তজেনা বিরাজ করছে। সরকার এটিকে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কূটচাল বলে মনে করছেন।
আবার বিরোধী দল যদিও এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেনি তারপরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আন্দোলন কার্যত মোদি সরকারকে অনেকটাই চ্যালেঞ্জ জানাতে চলেছে। ভারতের একজন প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদের মতে, এটি কোন নিছক বিদ্রোহ নয় এটি একটি বিপ্লব। এই বাম নেতার মতে, দেশ বদলে যাচ্ছে। যা মোদি সরকার ও এশিয়ার জন্য একটি বার্তা। তিনি যোগ করেন এই বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্টির প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে ভারতে। কৃষক আন্দোলনে অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বলে এই বাম নেতা মন্তব্য করেন। কৃষক আন্দোলনের এই অগ্নি সময়ে গত শুক্রবার উড়িষ্যায় তিন কৃষক আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। উড়িষ্যা বিধানসভার সামনেই কটকের অথাগড় ব্লকের ওই তিন চাষি গায়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন। উড়িষ্যা বিধানসভায় এখন শীতকালীন অধিবেশন চলছে। সেখানে কঠোর নিরাপত্তা রয়েছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে আন্দাজ করে নিরাপত্তারক্ষীরা দৌড়ে আসেন। কটকের তিন কৃষকের আত্মহত্যার প্রচেষ্টা রুখে দেওয়া হয়। পরে তাদেরকে আটক করা হয়। যাদের আটক আগুণে জল না পড়ে পেট্রোল পড়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম থেকে বলা হয়েছে। কটকের ওই তিন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের প্রতিবাদেই তাঁরা বিধানসভা ভবনের সামনে এসে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অথাগড় জেলা সমবায় ব্যাংকেঋণের অনিয়ম নিয়েও তারা অসন্তোষের কথা পুলিশকে জানিয়েছেন। যদিও তাদের আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে নতুন হিসাব নিকাষ শুরু হয়েছে।