ড. কাজী এরতেজা হাসান
প্রকাশ: রোববার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০, ২:০৯ পিএম আপডেট: ২৯.১১.২০২০ ৩:১৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
বৈশিষ্ট্য পাল্টে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী করোনা। এটা ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ফলে এখনই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ইতোমধ্যে দেশে আঘাত হেনেছে। করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এদিকে টিকার সাফল্য নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি দেশের মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার ব্যাপারে অনাগ্রহ এখনো বিদ্যমান। যদিও রাজধানীসহ দেশব্যাপী মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। তারপরেও হতাশার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল ভোরের পাতায় করোনার ‘লক্ষণ পাল্টে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ থেকে জানা যাচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের চারিত্রিক লক্ষণ যেমনটি ছিল, ফের করোনা আছড়ে পরার পরে তার স্বভাবে ভিন্নতা পাওয়া যাচ্ছে। আগের বারের থেকে করোনার এই চরিত্রের মধ্যে মিল নেই। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে চোখ ওঠা, পেশিতে ব্যাথা, ত্বকে লাল রাশ, চুলকানি, রক্ত জমাট বাঁধা, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা, অসংলগ্ন কথা বলা, হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখা- এইসব নতুন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এতে চিকিৎসকদের কিছুটা বিচলিত করে তুললেও চিকিৎসকরা করোনা রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা কাজে লাগাচ্ছেন এবং নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার হচ্ছে তাদের।এরপরও বলতে হচ্ছে যে, আমাদের চিকিৎসক সমাজ, আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। প্রথম দিকে চিকিৎসকরা নিজেরাই করোনার ব্যাপারে ভয়-আতঙ্কে ছিলেন। অনেক চিকিৎসক তখন নানা ছুঁতোয় হাসপাতালে হাজির হতেন না। এ বিষয়টি সরকারের চোখ এড়িয়ে যায়নি। সরকার চিকিৎসকদের সতর্ক করে দেওয়ায় তারা হাসপাতালে নিয়মিত হবার চেষ্টা করেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায়। আশা করা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিও সরকার সুন্দরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। তবে এখনো পুরোপুরিভাবে বুঝে উঠার সময় আসেনি, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। যদি প্রথম বারের থেকে সহনীয় পর্যায়ে বা নমনীয় হয়, তাহলে সবার প্রচেষ্টায় করোনাকে বশে আনা যাবে। করোনার থাবাকে হটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, মাস্ক পরার ব্যাপারে সরকার কঠোর মনোভাব দেখালেও কিছু মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে না। কিছু মানুষ, যথারীতি আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করছে। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে মাস্ক পরার ব্যাপারে আরো কঠোর হতে হবে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মাস্ক না পরলে জরিমানা বাড়ানো হবে। আমরা মনে করি-এটা কার্যকরের সময় এসে গেছে। সহনশীলতা না দেখিয়ে জরিমানা বাড়িয়ে দিতে হবে; তাহলে মাস্ক পরতে বাধ্য হবে মানুষজন। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ায়; শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। যদিও শিশুরা বেশি শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু শিশুরাও যে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, এটা হয়তো দেশের অনেকে অবিশ্বাস করলেও বাস্তবে শিশুদের আক্রান্তের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ফলে শিশুদেরকেও মাস্ক পরিয়ে বাইরে নিতে হবে।
করোনা টিকা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলেও আশা করা যায় এটা দ্রুত কেটে যাবে। বিশ্ববাসীর কাছে করোনা টিকা হাতে এলেই মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে তখন। আমাদের সরকার করোনা টিকা পাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টার কোনো ত্রুটি দেখাবে না। বিশ্বের অন্যদেশ যখন টিকা পাবে, আমরাও সে সময়ে পাবো বলে আশা করা যায়। করোনার সাফল্য নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এ বিষয়ে জানা যায়, ‘করোনা মহামারি মোকাবিলায় সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি টিকা আনার খবর দিয়ে দুনিয়ার তাবৎ গণমাধ্যমের শিরোনামে স্থান করে নেওয়ার কয়েকদিন পর অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের টিকার সাফল্যের হার নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টিকাটির দ্রুত অনুমোদন কষ্টকর হয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বেচ্ছাসেবকদের একাংশকে একটি ডোজ দেওয়ার পর আরেকটি পূর্ণাঙ্গ ডোজ না দিয়ে ভুল করে অর্ধেক ডোজ দেওয়ার পর টিকার সাফল্যের হার ৯০% পাওয়ায় টিকাটির সত্যিকারের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই প্রশ্ন তুলেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ‘আমাদের ট্রায়ালের সম্পূর্ণ তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলো এই ফলকে কিভাবে দেখে,’ বলেছেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের অধ্যাপক পিটার ওপেনশ’। টিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলোর পর্যালোচনার ফল ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে বলেও ধারণা দিয়েছেন তিনি।
সোমবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা এক ঘোষণায় অক্সফোর্ডের সঙ্গে যৌথভাবে বানানো তাদের পরীক্ষামূলক কোভিড-১৯ টিকার ব্রাজিল ও যুক্তরাজ্যে করা চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলে গড়ে ৭০ শতাংশ সফলতার কথা জানায়। এর মধ্যে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবককে দুটি পূর্ণাঙ্গ ডোজ দেওয়া হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে টিকাটির সাফল্য ৬২ শতাংশ। আর যে খুব ছোট অংশকে ভুল করে দেড় ডোজ দেওয়া হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে সাফল্যের হার পাওয়া যায় চোখ ধাঁধানো, ৯০ শতাংশ। এই ফলাফল নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। বলা হচ্ছে, যেখানে দুটি পূর্ণাঙ্গ ডোজ দিচ্ছে ৬২ শতাংশ সফলতা, সেখানে ভুল করে যাদের দেড় ডোজ দেওয়া হল, তাদের সাফল্য কীভাবে ৯০ শতাংশ হয়? ভুল করে যে অর্ধেক ডোজ দেওয়া হয়েছিল, তা কেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পূর্ণাঙ্গ ডোজের চেয়েও বেশি বাড়িয়ে দেয়? গবেষকরা এজন্য এখন অক্সফোর্ডের টিকার চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের সম্পূর্ণ তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন’। পরিশেষে বলার কথা হচ্ছে এই যে, প্রাণঘাতী করোনার অস্তিত্ব প্রবলভাবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ঘুণাক্ষরেও একে উপেক্ষা বা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার যৌক্তিকতা নেই। এর হাত থেকে সুরক্ষা পেতে মাস্ক পরা অপরিহার্য করে তুলতে হবে। আর টিকা বা ভ্যাকসিন গবেষকরা পুরোপুরিভাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাক, এটাই কাম্য হওয়া উচিত হবে। এবং বয়স্ক মানুষের পাশাপাশি শিশুদের ব্যাপারেও অবজ্ঞার সুযোগ নেই।