চলমান কোভিড-১৯ মহামারিকে শতভাগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে তারা নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের সাথে মিশে নানাবিধ ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নের কিছুটা অগ্রগতি হলেও তা সন্তোষজনক নয়। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক’ এ বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ৬৮ অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনও তামাক কোম্পানির শক্তিশালী হস্তক্ষেপ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আজ শনিবার ঢাকায় প্রকাশিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক: এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২০’ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনলাইনভিত্তিক জুম সফটওয়্যারের মাধ্যমে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, তামাক অপরিহার্য পণ্য তবে শুধু মৃত্যুর জন্য, জীবনের জন্য নয়। এটি কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় থাকতে পারে না। বরং এটি সংবিধানের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। আমি ইতোমধ্যেই তামাকপণ্যকে এই তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য জাতীয় সংসদে বেসরকারি সদস্য বিল জমা দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, কোভিড এর মধ্যে অনেক তামাক কোম্পানিকে প্রণোদনার টাকা দেয়া হয়েছে এটা হতে পারে না। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বিশেষ অতিথি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রাক্তন সমন্বয়ক মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস বলেন, সরকার সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমি আশা করবো, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় নিজ মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালকে আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করবে যাতে চলমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়াসহ সকল ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা যায়।
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তামাক ব্যবহার কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এটা এমন একটা সমস্যা যার সমাধানে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয় বরং সকল মন্ত্রণালয় মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে তামাক কোম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে নীতিনির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রশাসনযন্ত্রের সাথে মিশে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় এবং তামাকনিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছে। একইসাথে এসব সিএসআর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনমনে নিজেদের সর্ম্পকে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্ট করেছে কোম্পানিগুলো। ২৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর হাতে অনুদানের চেক হস্তান্তর করে এবং এ সংক্রান্ত সংবাদ ও ছবি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে প্রচার করা হয়। তামাককোম্পানিগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর-কে ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে এনবিআর জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯ চূড়ান্তকরণে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি প্রদান করেছে। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিক্যাল ৫.৩ এ তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতি প্রণয়নে তামাক কোম্পানিকে কোনোভাবে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে নানামুখী চাপ সত্ত্বেও গবেষণা চলাকালীন সময়পর্যন্ত জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯ এর খসড়া প্রণয়নে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে বিড়ি মালিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারির মাধ্যমে নন-ফিল্টার বিড়ির শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে এনবিআর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার থাকার পরও বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জাপান টোব্যাকো কর্তৃক বিপুল রাজস্ব প্রদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তামাকের ওপর ‘যৌক্তিক’ করারোপ করার অনুরোধ জানান শিল্প মন্ত্রীর কাছে।
গবেষণার সুপারিশে আইন সংশোধন করে তামাক কোম্পানির সকল প্রকার সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। পাশপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করতে সুপারিশ করা হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলো খুব সহজেই এসব মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করতে পারে যার নজির চলমান কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে দেখা গেছে। দুইটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানি করোনাকালীন লকডাউনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সিগারেট উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ এবং তামাকপাতা ক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিশেষ অনুমতি আদায় করে নেয়। এই বিশেষ অনুমতি প্রত্যাহার এবং করোনা মহামারির সময়ে সাময়িকভাবে তামাক পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যা শেষ পর্যন্ত নাকচ হয়ে যায়। এছাড়াও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার, তামাক কোম্পানি এবং এর প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের সকল তথ্য এবং নথি প্রকাশ, তামাক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে আচরণবিধি চূড়ান্তকরণ এবং তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রত্যাহারসহ তামাক ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করে আসছে। এবছর বিশ্বের ৫৭টি দেশে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি। ২০২০ হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৬৮, যা গতবছর ছিল ৭৭। গবেষণায় সরকার তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপসমূহ কিভাবে আমলে নেয় এবং সেগুলো মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি। ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস এর স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অরগানাইজেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস) প্রজেক্ট এর আওতায় এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি), থামাসাত ইউনিভার্সিটি থাইল্যান্ড।
ওয়েবিনারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন মো: শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ কান্ট্রি অ্যাডভাইজার, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস; ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক, ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা; সৈয়দ মাহবুবুল আলম, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, দি ইউনিয়ন; এম এ সালাম, গ্রান্টস ম্যানেজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এবং এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা। এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। ওয়েবিনারে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, তামাকবিরোধী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক ও এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মসূচি প্রধান মো. হাসান শাহরিয়ার।