সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, প্রথিতযশা অভিনেতা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক আলী যাকেরের জীবনাবসান ঘটেছে। গতকাল শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। গত চার বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে আসা এই অভিনয় শিল্পী গত ১৫ নভেম্বর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু দুদিন আগে শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে গতকাল ভোরে না ফেরার দেশে চলে যান ৭৬ বছর বয়সী এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
গত শতকের সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ আর টেলিভিশনে দাপুটে অভিনয়ের জন্য দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেতা। তার স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকের বলেন, ‘অভিনয় বা কর্মজীবনের বাইরে ভীষণ এক সংসারী মানুষ ছিলেন আলী যাকের। তিনি নাটকের মত করেই সংসারটাকে ভালোবাসতেন। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন, বাড়ি বানাবেন, এমন সব স্বপ্ন তার ছিল না। তিনি সবসময় এক মধ্যবিত্ত, রোমান্টিক জীবনযাপন করতে চাইতেন।’
দীর্ঘ বিশ বছর পর নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সাড়া জাগানো নাটক ‘গ্যালিলিও’ আবার মঞ্চস্থ হয় ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর। ঢাকার জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে ওই নাটকের মধ্য দিয়েই দীর্ঘদিন পর মঞ্চে ফেরেন অভিনেতা আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর। মঞ্চে ‘গ্যালিলিও’ নাটকটিই তার শেষ নাটক। ক্যান্সারে আক্রান্ত অভিনেতা আলী যাকের সেই নাটকের নাম ভূমিকায় ছিলেন। ছিলেন আমৃত্যু নাগরিক নাট্যদলের প্রধান।
আলী যাকেরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পরবর্তীতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনসহ দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন আলী যাকের। এ নাট্যজনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো।’ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও এই অভিনেতার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। এক শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘তিনি তার অভিনয় ও সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে এদেশের অগণিত দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।’
আলী যাকেরের মরদেহ শুক্রবার বেলা ১১টায় নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে। একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দ সৈনিককে সেখানে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে বিকালে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, শেষ দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার জন্য শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন রাখা হয়নি।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মোহাম্মদ তাহের ও তার স্ত্রী রিজিয়া তাহেরের ঘরে আলী যাকের যখন জন্ম নিলেন, চারপাশে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। চট্টগ্রামে জন্ম হলেও আলী যাকেরের পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বাবা মোহাম্মদ তাহেরের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলী যাকের। ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়া ঘুরে বাবা যখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব হলেন, তখন আলী যাকেরের পরিবার থিতু হয় ঢাকায়। সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে আলী যাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়, সেই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিতে। আলী যাকের তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলে তিনি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিউ এস ক্রফোর্ডাসে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে আলী যাকেরের কর্মজীবন শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন, মৃত্যুর সময় তিনি কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রচারযুদ্ধে অংশ নিতে। আলী যাকের যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। শেষে স্বাধীন দেশে ফেরার পর ব্যস্ত হন এশিয়াটিককে দাঁড় করানোর কাজে। অভিনেতা, নির্দেশক মামুনুর রশীদের সঙ্গে তখন তার দারুণ বন্ধুত্ব। সেই সূত্র ধরেই ১৯৭২ সালে আরণ্যকের ‘কবর’ নাটকে অভিনয় করেন আলী যাকের, শুরু হয় মঞ্চে তার পথচলার। সে নাটক দেখে পরে জিয়া হায়দার ও আতাউর রহমান তাকে নিয়ে যান তাদের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। মৃত্যু পর্যন্ত আলী যাকের এই নাট্যদলের সভাপতি ছিলেন। মঞ্চে নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজীর চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় এখনও দর্শক মনে রেখেছে। ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি পাথর’, ‘আজ রবিবার’ এর টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন।
‘অচলায়তন’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের। বেতারে অর্ধশতাধিক শ্রুতি নাটকেও কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন ‘রাবেয়া’, ‘লালসালু’, ‘নদীর নাম মধুমতী’ সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। নানা বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেছেন দীর্ঘদিন। প্রকাশিত হয়েছে বই— ‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’। শখ করে ফটোগ্রাফিও করতেন তিনি। অভিনয়, নির্দেশনার বাইরে তিনি ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক; পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সঙ্গে। নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন আলী যাকের। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৮-তে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আলী যাকের যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিরও সদস্য ছিলেন। আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকেরও মঞ্চ আর টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। তাদের দুই ছেলেমেয়ে ইরেশ যাকের ও শ্রিয়া সর্বজয়াও অভিনয়শিল্পী।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘গার্ড অব অনার’ :একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক অভিনেতা, নির্দেশক আলী যাকেরের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, অশ্রুচোখে বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীরা তাকে জানিয়েছেন শেষ বিদায়। প্রয়াত এই অভিনেতার মরদেহ শুক্রবার বেলা ১১টার পর শেরেবাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ট্রাস্টি।
জাদুঘর প্রাঙ্গণে আলী যাকেরের কফিন জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেন জাদুঘরের ট্রাস্টিরা। সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন স্ত্রী সারা যাকের, ছেলে ইরেশ যাকের এবং আলী যাকেরের অভিনয় জীবনের বন্ধু সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলী যাকেরের মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়া এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রথমে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পরে একাত্তরের শব্দসৈনিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। এরপর একে একে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ছায়ানট, থিয়েটার, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় এ অভিনেতার প্রতি।