#ভাস্কর্য কোনভাবেই ইসলাম অসঙ্গত নয়: ড. মোঃ হারুন-উর-রশিদ আসকারী।
#তাদের কাছে দোষ ভাস্কর্যের নয়, দোষ হচ্ছে মুজিবের: কে এম লোকমান হোসেন।
#নৈরাজ্য সৃষ্টি কারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে: হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান।
#আমার দেশ সব বর্ণের, সব ধর্মের বাংলাদেশ: সাদ বিন কাদের চৌধুরী।
আফগানিস্তানের অনুকরণে সম্প্রতি বাংলাদেশেও ভাস্কর্য ভাঙার দাবি তুলেছে কওমি বা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিতদের একটি অংশ। দিন যত যাচ্ছে আমরা আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। ধর্মকে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে লোভের অংশ হিসেবে। ধর্মকে রাজনীতির অংশ পরিণত করতে করতে, একে পেশাও বানিয়ে ফেলা হয়েছে। পেশা থেকে তা ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাঁকোও হয়ে উঠেছে। জল কিন্তু বহুদূর গড়িয়েছে। এদের এখনি প্রতিরোধ করতে হবে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৬৮ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হারুন-উর-রশিদ আসকারী, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, সাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি কে এম লোকমান হোসেন। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ড. মোঃ হারুন-উর-রশিদ আসকারী বলেন, ধন্যবাদ জানাই বিজ্ঞ সঞ্চালক ও ভোরের পাতাকে আজকে আমাকে এই সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। দেখুন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আজকে সংলাপের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সারা বিশ্ব যখন এই করোনার ভয়াল থাবার মধ্যে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থার মধ্যে আছে সেখানে বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য, দক্ষ ও চৌকশ নেতৃত্বে বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে একটি অনর্থক বিষয় নিয়ে জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা ভাস্কর্য নয়, ভাস্কর্য কার করা হচ্ছে সেখানেই তাদের আপত্তি। ভাস্কর্য মূর্তি নয়, ভাস্কর্য কোনভাবেই ইসলাম অসঙ্গত নয়। আল্লাহ এবং রাসুল ছাড়া আর কারো প্রতিকৃতি করা যাবেনা যার দারা কোন পৌত্তলিকতা করা যাবে না বা মান্য করা যাবেনা। আজকে এত বছর অন্য প্রসঙ্গ সামনে এনে এই হাদিসটির ব্যাবহার করে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে কোন্দল পাকাতে চাচ্ছে। ধর্মকে অবমাননা করার কথা শুধুমাত্র তারাই বুঝে যারা এই ধর্মকে ব্যবহার করে দেশের ইতিহাস মুছে দেওয়ার নোংরা ষড়যন্ত্র করছে আর ভাস্কর্য কখনোই ধর্ম অবমাননা করার মাধ্যম হয়না ভাস্কর্য মানে ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। প্রতিমা, ভাস্কর্য ও মূর্তি। প্রতিমা হল মানুষ যার আরাধনা উপাসনা করে, ইহকালে-পরকালে মঙ্গল চায়, ভুলের ক্ষমা চায় ইত্যাদি। ভাস্কর্য হল মানুষসহ কোনো প্রাণী বা কোনো কিছুর মূর্তি যাকে মানুষ রাখে সম্মান দেখতে বা সৌন্দর্য্য বর্ধন করতে, যার মানুষ আরাধনা বা উপাসনা করে না। ইসলামে ভুল ব্যখ্যা দিয়ে কিছু রাষ্ট্র বিরোধী লোক আছে তারা উল্টা পাল্টা কথা বলে এদেরকে ডিজিটাল আইনের আওতায় আনা হোক। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ ছিল না তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলে আমর বিন আসের মিশর অভিযানে ফারাও ও স্ফিংস ভাস্কর্য অক্ষত ছিল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের ইরাকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সময়ও কোনো মূর্তি ভাঙ্গা হয়নি। ধর্মের দোহাই দিয়ে কিছু দিন আগেই একজন ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। এই ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলেই পরবর্তীতে অন্য কোনো ব্যক্তি, অন্য কোনো স্থানে সাহস পায় ধর্মকে ব্যবহারের। লালমনিরহাট কেবল উদাহরণ মাত্র। প্রতীক মাত্র। ধর্ম ছাড়াও সাধারণ গুজব ছড়িয়ে দেশের আনাচে কানাচেতে প্রায়ই নানান ঘটনা ঘটছে। যার নেই প্রতিকার।
কে এম লোকমান হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর যে দ্বিতীয় বিপ্লব যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন, সেই অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে যখন তিনি কাজ শুরু করলেন তখন তাকে তার সপরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ যাতে আবারো পাকিস্তানে পরিণীত হতে পারে তার জন্য সেসময় অনেক প্রচেষ্টা করা হয়েছে। এইজন্য সেসময় জিয়াউর রহমানের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে ১৯৭৯ সালে দেশ ছাড়তে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা আজকে তারই রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার গতিতে আছেন ঠিক সেই সময়ে সেই আগের ষড়যন্ত্রের প্রেতাত্মারা আবার সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার উপর দাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে যেসব অধ্যায় পার করে জাতি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে এক শ্রেণির হুজুরদের বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। আজকে পদ্মা সেতুর গড়ার ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব যেভাবে যোগাযোগ খাতে বিপ্লব অর্জন করছে তাতে অতি শীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে যাবে। এটা সত্য যে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ইস্যু করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। তাদের রুখে দিতে হবে, দেশ ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা স্বাধীনতা, সংবিধান ও আইনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তারা দেশদ্রোহী। এমন মানুষদের কঠিন বিচারের মুখোমুখি না করলে আদতে কোনো উন্নয়ন কাজে আসবে না। দেশ কেবল পেছাবেই। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তারাই করছে, যারা ঘুরে ফিরে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা নিতে চায়। তাদের কাছে দোষ ভাস্কর্যের নয়, দোষ হচ্ছে মুজিবের! মুজিব কেন জন্ম হয়েছিলেন। মুজিব কেন দেশ স্বাধীন করেছিলেন, মুজিব কেন বাঙ্গালিকে নিয়ে চিন্তা করেছিলেন, আর মুজিব তনয়া কেন আজ বাংলাদেশকে নিয়ে এতো এগিয়ে যাচ্ছেন!! তাদের হিংসা মূলত এই জায়গায়।
হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ভাস্কর্যের বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা সাবার ১৩ নং আয়াতে বলেছেন: “তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী উপাসনালয় ও দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! (এসব নেয়ামতের জন্য) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (যদিও) আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।” (৩৪:১৩)। এই সূরার একটি আয়াতে তামাসিল আরবি শব্দ রয়েছে যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ভাস্কর্য। আরেকটি সুরা ইব্রাহিমের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: '(স্মরণ কর সে সময়ের কথা) যখন ইব্রাহীম বললেনঃ হে পালনকর্তা, এ শহরকে তথা মক্কাকে শান্তিময় ও নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন।' মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিজ্ঞ হযরত ইব্রাহীম (আ.) সত্য-সন্ধানী মানুষের হৃদয়কে তৌহিদের বাণীর মাধ্যমে আলোকিত করেছেন এবং অজ্ঞতার আঁধারে ডুবে-থাকা একদল মানুষকে আলোর পথে এনেছেন। এই দুইটি আয়াতের মধ্যে তামাসিলা শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাস্কর্য আর পরের আয়াতে যে আসনাম আরবি শব্দটি রয়েছে যার অর্থ প্রতিমা পূজা। এখন স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদীরা যাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন অবদান নেই, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বসে বসে তামাশা দেখেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন এই দেশে অরাজকতা চালিয়েছে তখন তারা তাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করেছে তারা আজকে এই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনে এটাকে নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। ৭১-এর আগে, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শ্রেণির তথাকথিত আলেম-উলামা যা করেছেন এর কারণে সমাজে তাদের সম্বন্ধে স্বাভাবিকভাবেই একটি নেতিবাচক ধারনা বিদ্যমান। যেখানে দেশ প্রেমকে ঈমানের অঙ্গ বলা হচ্ছে, সেখানে তারা ওই সময় এই হানাদার বাহিনীদের বিরুদ্ধে না গিয়ে তাদের আরও উৎসাহিত করেছেে এবং আজকে তারা এই দেশের জন্য যারা নিজের জীবন দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছে। শেষে এটাই বলব, এ দেশ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার। আমরা চাই, সবাই তার নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। এক্ষেত্রে যারা বিরোধ সৃষ্টি করতে চাইবে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা যারা ধর্মের নামে অধর্ম করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার পায়তারা করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে সমাবেশ করেছে মৌলবাদী দুই নেতা। তাদের দাবি, মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তৌহিদি জনতার আন্দোলন চলবে। সরকার যদি ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন থেকে সরে না আসে, তাহলে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে তারা। যেই মহান ব্যক্তির জন্য বাংলাদেশের জন্ম তার ভাস্কর্য বানালে নাকি সেই ভাস্কর্য মৌলবাদীরা বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করবে। এমন আক্রমণাত্মক ভাষায় হুঙ্কারও দিয়েছেন কিছু ধর্মব্যবসায়ী ধর্মান্ধরা। তাদের দাবি, ভাস্কর্য নাকি মূর্তি। তাই মসজিদের শহরে মূর্তি স্থাপন করা যাবে না। আসলে এই মৌলবাদীরা শান্তিময় দেশকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তান বানাতেই মাঠে নেমেছে। তারা কখনও আন্দোলন করে ধর্ম অবমাননার নামে, কখনও কাউকে কাফের আখ্যা দেয়ার নামে, আবার কখনও ভাস্কর্য অপসারণের নামে। আসলে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। আজ এদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তোলা হচ্ছে। তারা যে আসলে ধর্মান্ধ এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি তা আবারো স্পষ্ট করেছে। আমার দেশ সব বর্ণের, সব ধর্মের বাংলাদেশ।