আসামিপক্ষে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাঁর সঙ্গে এ সময় যুক্ত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
গত বছরের ১১ জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে শুনানি শেষে সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) রেখেছিলেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন।
একই বছরের ১১ এপ্রিল এ মামলায় চারজন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে আইনি সহায়তাকারী) নিয়োগ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। তাঁরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। অ্যামিকাস কিউরিরা হলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, আব্দুর রেজাক খান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন।
তখন শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যাবজ্জীবন সাজার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকতে হবে। আমাদের আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হিসেবে ৩০ বছর বলা আছে। যা রেয়াত পাওয়ার পর সাড়ে ২২ বছর হয়। উন্নত বিশ্বেও সাজার মেয়াদ বলে দেওয়া হয়। সেখানে প্যারোল ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড প্রাপ্তদের দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই। তাই যাবজ্জীবন হিসেবে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলে কারাগারগুলো বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাবে।
২০০১ সালে সাভারে জামান নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার দায়ে ২০০৩ সালে ঢাকার একটি আদালত কামরুল, আতাউর ও আনোয়ার নামের তিন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ সাজার বিরুদ্ধে আতাউর ও আনোয়ার হাইকোর্টে আপিল করেন। একই সঙ্গে নিম্ন আদালত থেকে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়।
ওই ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৭ সালে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন। আপিলের ওপর শুনানি শেষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে আপিল বিভাগ রায় দেন।
রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ 'যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস'- এমন মন্তব্য করেন বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তবে ওই দিন অন্যান্য মামলার আসামির ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে কিনা? সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সবার ক্ষেত্রে এ রায় প্রযোজ্য হবে কিনা, সেটি পূর্ণাঙ্গ রায় না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।
একইদিন খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রায়ের সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু (ন্যাচারাল লাইফ) কারাবাস। তখন আমি এর প্রতিবাদ করেছি।
'আমি বলেছিলাম, দণ্ডবিধির ৫৭ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৩০ বছর। এছাড়া যাবজ্জীবনের আসামিরা কারাগারে রেয়াত পেয়ে দণ্ড আরও কমে আসে। যদি আমৃত্যুই হয়ে থাকে, তাহলে তাদের রেয়াতের কি হবে? আমি আরো বলেছিলাম, প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য যেন মূল রায়ে না থাকে। তবে যদি থাকে, তাহলে সব আসামির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে।'
ওইদিন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সাভারের একটি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। তবে আদেশে বলেছেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর নয়, আমৃত্যু কারাদণ্ড। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর।
২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ মামলার ৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশিত হয়। পরে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আতাউর রহমান মৃধার আইনজীবী ওই রায়ের রিভিউয়ের কথা সাংবাদিকদের জানান। পরে রিভিউ করেন আতাউর রহমান মৃধা।
এদিকে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটাই বিধান। এক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডটা হচ্ছে ব্যতিক্রম। যখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাউকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তখন এর কারণ অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৪৫ ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
আদালত আরো বলেন, যদি হাইকোর্ট বিভাগ বা এ আদালত (আপিল বিভাগ) মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন তখন এবং নির্দেশ দেন যে তার স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত এ কারাদণ্ড ভোগ করবেন, তখন এ ধরনের মামলায় সাজা কমানোর আবেদন গ্রাহ্য হবে না।
আদালতের ওই রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাপর আসামির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয় স্বরাষ্ট্র সচিব ও কারা মহাপরিদর্শককে।