যে কোন চিকিৎসকের জন্য মেডিক্যাল হিউম্যানিটিজ এবং পাবলিক হেলথ এর জ্ঞান থাকা জরুরি। দেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যে কেউ একটি ডিগ্রী নিয়েই শিক্ষক হতে পারেন কিনা, সে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
এক সময় সমাজে এবং পরিবারে চিকিৎসক সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি থাকলেও এখন আর তা নেই। রোগী বেশি পাওয়া মানেই ভালো চিকিৎসক নয়। সমস্যাগুলো উত্তরণে কমিউনিটি মেডিসিন' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মেডিক্যাল শিক্ষার মানোন্নয়ন করা না গেলে দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি স্বাস্থ্য খাতে আসবে না। মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক কারিকুলাম পরিহার করতে হবে।
শনিবার (২১ নভেম্বর) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত জানান। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানে গতকালের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- বাংলাদেশে মেডিক্যাল এডুকেশনের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. তৌফিক জোয়ার্দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের পাঠ্যক্রম উন্নয়ন ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর তালুকদার, যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী ড. শাহাদুজ্জামান, বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক হুমায়ুন প্রশ্ন রেখে বলেন, শিক্ষার্থীরা কি স্বেচ্ছায় চিকিৎসক হতে চাইছেন নাকি পারিবারিক চাপ বা অন্য কোন কারণে এ পেশায় আসছেন তা ভেবে দেখতে হবে। চিকিৎসার মতো মানবিক পেশার সাথে নীতি-নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব সহ নানা বিষয় জড়িত। তাই এক্ষত্রে পড়তে ইচ্ছুকদের আচরণ, প্রবণতা লক্ষ্য করা জরুরি হলেও শুধু 'এমসিকিউ' দিয়ে তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। বিগত ১০ বছরে মেডিক্যালে ৬৫% এর বেশি নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। দেশের জন্য তা ভালো খবর হলেও স্বাস্থ্য শিক্ষার পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে তারা ভবিষ্যতে কতটা কার্যকরী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন সে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। যে কেউ একটি ডিগ্রী নিয়েই শিক্ষক হতে পারেন কিনা, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। যোগ্য শিক্ষক না থাকলেও কারিকুলাম যতোই মানসম্পন্ন হোক, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
এরকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানান ড. শাহাদুজ্জামান। তিনি বলেন, দেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা দ্রুতবর্ধমান হলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। স্বচ্ছল রোগীরা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের অর্ধেকের বেশী বাংলাদেশ থেকে আসে। চিকিৎসক ও নার্সদের পারফরম্যান্স, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং সিস্টেমের সমস্যার কারণে অনেকের মধ্যেই ধারণা জন্মেছে তারা বিদেশে আরো উন্নত চিকিৎসা পাবেন৷ এক সময় সমাজে এবং পরিবারে চিকিৎসক সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি থাকলেও এখন আর তা নেই। দেশের চিকিৎসকদের উপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ 'চিকিৎসক হয়ে উঠার' গোটা প্রক্রিয়ায় জুড়ে থাকা সমস্যা। অনেক জায়গায় অনন্যোপায় মানুষ চিকিৎসকের কাছে ভীড় জমান। তাই রোগী বেশি পাওয়া মানেই ভালো চিকিৎসক, বিষয়টা সেরকম নয়। রোগীদের চিকিৎসকের কাছে মেডিক্যাল এবং নন মেডিক্যাল দুই ধরনের প্রত্যাশার জায়গা থাকে। বাংলাদেশে চিকিৎসকদের শুধু মেডিক্যাল প্রত্যাশা পূরণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অথচ রোগী চিকিৎসকের কাছে যাবেন অসুস্থতা নিয়ে, বের হবেন অসুখ নিয়ে। চিকিৎসককে রোগীর অসুস্থতা অনুভব করতে হবে, বুঝতে হবে। এক্ষত্রে 'কমিউনিটি মেডিসিন' বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারলেও এই বিষয়টি সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বিষয়গুলোকে কারিকুলাম 'অভিজাত' বলে দেখায় বলে এই বিষয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও হীনমন্যতা আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনীহা কাজ করে। কিন্তু ডাক্তারি পড়ে শিক্ষার্থীরা যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায় তখন তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার মতো 'বেসিক কমিউনিকেবল ডিজিজ' মোকাবিলা করতে হয়। তখন তাদের বিপদে পড়তে হয়। তাই কমিউনিকেটিভ মেডিসিনের স্ট্যাটাস বাড়াতে হবে, এর গুরুত্ব বোঝাতে হবে।
ডা. জিয়াউদ্দিন বলেন, দেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলেও এখনো প্রতি দশ হাজার জনের বিপরীতে মাত্র পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি কম্বোডিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে নিজের কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসংগে বলেন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া 'কোয়ালিটি অফ কেয়ার' কে সামনে রেখে মেডিক্যাল এডুকেশনে বড় ধরনের সংস্কার করছে। তিনটি দেশেই সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন সংস্থা গঠন করা হচ্ছে যারা শিক্ষার্থীরা পাশ করে বের হবার পর তাদের লাইস্যান্সিং পরীক্ষা নেবে, যে যেখান থেকেই পাশ করুক না কেন স্বাস্থ্যখাতে যোগ দেবার আগে তারা যেনো যোগ্য হয়ে গড়ে উঠে তা নিশ্চিত করবে। চিকিৎসক এবং নার্সরা কর্মস্থলে যোগদানের পরও তাদের দক্ষতা, যুগের প্রয়োজনে নিজেদের পরিবর্তন করা ইত্যাদি মনিটরিং করবে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা পর্যবেক্ষণ করবে। তাছাড়া কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য প্রশাসনের উপর বিশেষ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যাতে সব চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য প্রশাসন চালাবার ন্যূনতম ধারণা থাকে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নের একটি বড় স্তম্ভ হলো মেডিক্যাল শিক্ষার মানোন্নয়ন করা৷ মেডিক্যাল শিক্ষার মানোন্নয়ন করা না গেলে দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি স্বাস্থ্য খাতে আসবে না। ফলে স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নও সম্ভবপর হবে না।
অধ্যাপক হুমায়ুন বলেন, অন্য কোথাও ভালো কিছু করতে না পেরে অনেকেই জনস্বাস্থ্যে কাজ করতে আসেন। এ ধরনের নীতিনৈতিকতা বর্জিত মানুষের কাছে ভালো কিছু আশা করা যায়না। মেডিক্যালে তিন বছর কমিউনিকেটিভ মেডিসিন পড়ানোর কথা থাকলেও পড়ানো হয় এক বছর। শিক্ষার্থী ভর্তির পর প্রথম বর্ষে পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীল আচরণ, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা দেয়া হয়না।
তার মতে, মেডিক্যাল এডুকেশনের কারিকুলামে রাতারাতি পরিবর্তন বা হুট করে সংস্কার না করে ক্রমশ এসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। যারা এক বছর বা দু বছর পর মেডিক্যালে ভর্তি হবে তারা যেনো আগে থেকেই জানতে পারে তাদের কি কারিকুলাম পড়তে হবে, ইন্টার্নি কোথায় করতে হবে ইত্যাদি।
ডা. জিয়াউদ্দিন বলেন, দেশে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদির রোগী বাড়ছে। বায়ুদূষণ জনিত কারণে বছরে ৪৬,০০০ মানুষ মারা যায়। মেডিক্যাল শিক্ষাকে এসব স্বাস্থ্য প্রয়োজনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে। সেজন্য বর্তমান নয়, ২০ বছর পর জাতীয় এবং বৈশ্বিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলাম সংস্কার করতে হবে। মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক কারিকুলাম পরিহার করতে হবে। মেডিক্যালে অধ্যয়নকালে একদিনের জন্যেও শিক্ষার্থীকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না দিয়ে চিকিৎসক হবার সাথে সাথে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া রীতিমতো অন্যায় আবদার। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাচিপ, ড্যাব এর মতো সংগঠনগুলোকে কখনো চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীদের পেশাদারিত্বের যোগ্যতা বাড়াতে কখনো কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
আলোচনায় স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে মেডিক্যাল এডুকেশনকে অবশ্যই দক্ষতা ভিত্তিক করতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বক্তারা সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ভোরের পাতা/এএ