#অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে সশস্ত্র বাহিনী আজকের গৌরবের জায়গায় এসেছে: মেজর জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ আলী শিকদার।
#বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষা নীতির আদলেই সশস্ত্র বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা: মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ।
#বাংলাদেশকে নিয়ে শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে: অধ্যাপক ড. শাহীনূর রহমান।
‘মুজিববর্ষ’ ও করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে পালিত হচ্ছে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস। বাংলাদেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত এবং একে অপরের সম্পূরক। দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান মূল্যায়ন করলে এই দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। উপরন্তু গত সাড়ে ১১ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন ও তাদের কার্যক্রমের সাফল্যগাথা বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট হবে এই দিবসটি উদযাপনের তাৎপর্য।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৬৫ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। শনিবার (২১ নভেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ আলী শিকদার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সামরিক গবেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহীনূর রহমান। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
মেজর জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবস অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার একটি ভিন্নভাবে উৎযাপন হচ্ছে। বাংলাদেশের ও বাঙালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের জায়গা হচ্ছে ৭১, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের জায়গা হচ্ছে ৭১। সুতরাং ৭১ এর সূত্রে যা কিছু হয়েছে এবং আগামীতে যা হবে তা সব কিছু একটি ভিন্ন মাত্রা বহন করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য, সশস্ত্র বাহিনীর সকলের জন্য। যেহেতু আমরা ৭১ এর প্রজন্ম ও ৭১ এ যুদ্ধ করেছি তাদের স্মৃতিতে ৭১ এর কথাটাই বার বার ভেসে উঠে। এই যে ২১শে নভেম্বর ১৯৭১ সালে, তখন আমাদের তিনটি বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রেই একটির পর একটি এই যুদ্ধের মাঠেই তাদের জন্ম হয়। এই তিনটি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে সম্মলিত আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়। তখন আমরা যারা সেনা বাহিনীর সদস্য নয়, অর্থাৎ যারা গেরিলা বাহিনী ছিলাম; আমরা আকাশ বানী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এই খবরটি পেলাম যুদ্ধ ক্ষেত্রে তখন সেই অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। তখন সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি শক্ত মনোবল তৈরি হলো। আমরা মনে করলাম, আর বোধহয় বেশি দেরী নেই নতুন সূর্য উদয়ের এবং সেটিই কিন্তু আমরা দেখেছিলাম। এই ২১শে নভেম্বরের পরে মাত্র ২৩ দিনের মাথায় এই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের আরও ৬ মাস যুদ্ধ করার ক্ষমতা থাকা সর্তেও, তাদের সকল যুদ্ধের সরঞ্জাম অক্ষত থাকা অবস্থায় অবনত মস্তকে প্রকাশ্যে জনতার সামনে বিনা শর্তে আমাদের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা বাধ্য হয় পশ্চাদপসরণে। সুশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের ইতিহাস। তারপর মিত্র বাহিনীর সহযোগে ঘোষিত হয় সার্বিক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির মিলিটারি একাডেমিতে। সুতরাং এই যে সশস্ত্র বাহিনীর তাৎপর্যের অনেক গুলো দিক ছিল যার একটি মাত্র দিক আমি বললাম। আজকে সেই জায়গা থেকে আজকের সশস্ত্র বাহিনীর যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ৪৯ বছর পেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে, অনেক উত্থান-পতন পার করে এই গর্বের জায়গায় পৌঁছে গেছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এই দিবসটি নিয়ে অনেক গর্ব করি। মাঝখানে একটা সময় গিয়েছে ১৯৭৫ সালে, তখন আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভালো সময় কাটায়নি। একসময় মনেই করে বসেছিলাম যে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধটা করে কি ভুল করলাম! কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের এই ধারণাটা ভুল হয়েছে যে বাংলাদেশের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী একাত্ম হয়ে আত্মার সম্পর্ক স্থাপন করে যে চেতনা ও চেতনার যে শক্তি সেটি বিন্যাস হবার নয় বলেই সশস্ত্র বাহিনী সে জায়গা থেকে ঘুরে দাড়িয়ে আরও অনেক দূরে অগ্রসর হয়েছে।
মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, প্রথমেই সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে। এই দিনটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এই দিনটির সাথে সশস্ত্র বাহিনীর জন্মের ও এগিয়ে যাওয়ার যে একটি বিষয় আছে ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র বাহিনীর যে ভূমিকা সেটি ফুটে উঠেছে। এখানে আমি আরও একটি বিষয় বলতে চাচ্ছি যে, সশস্ত্র বাহিনী কিভাবে পরিচালিত হবে, কিভাবে গঠিত হবে, এটা কিন্তু পলিটিকাল ডিসিশন যেটাকে আমরা পলিটিকাল কন্ট্রোল অফ দ্যা মিলিটারি বলে থাকি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবো যে, মুজিবনগরে বাংলাদেশের যখন প্রথম সরকার গঠিত হলো তার কিছুদিন পরেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে হবে কিভাবে পরিচালনা হবে সেটা সেখানে পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয়। তার পরবর্তীতে নভেম্বর মাসে এসে সব বাহিনী একত্রিত হয়ে এককভাবে তাদের অস্তিত্ব তৈরি করলো। আট মাস পর ৭১ সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। আর ২১শে নভেম্বরের দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যটি হচ্ছে, যখন সব বাহিনী একত্রিত হয়ে হানাদার বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করার সক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ করা শুরু করলো এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করলাম। এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। এই যে তিন বাহিনীকে একত্রিত করেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই এই দিনটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল জনতার সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি উদ্দীপক বিভাব। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। এখন যখন বাংলাদেশের সৃষ্টির পরে এই সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের বিনির্মাণে যেমন ভূমিকা রেখেছে ঠিক তেমনি বিদেশে শান্তি স্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেও অদূর ভূমিকা রেখেছে। এই ভূমিকা রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর যে পর্যাপ্ত সক্ষমতা দরকার ছিল তা বাড়ানোর জন্য আমাদের রাজনৈতিক সরকার করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিরক্ষা নীতি তৈরি করেছিলেন। সেই প্রতিরক্ষা নীতির আলোকেই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গড়ে উঠেছে এবং তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আদলেই একটি সক্ষম বাহিনী তৈরি করার লক্ষে সম্পূর্ণভাবে একটি পরিকল্পিত মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক ড. শাহীনূর রহমান বলেন, আজকের এই যে দিনটি আমাদের জন্য গৌরবের দিন। আমরা সকলে জানি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আজকেই এই দিনটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণতম একটি দিন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সাড়া দিয়ে বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় আজকের এই দিনে নৌ বাহিনী ও বাহিনীর সম্মলিত ভাবে হানাদার বাহিনীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে যা একটি বড় ইতিহাস। ৭ মার্চ থেকে ২১ নভেম্বর, মাত্র ৮মাস ১৪ দিন পর জন্ম নিল; বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ, দুর্নিবার আক্রমণ। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ৭১, অর্জিত হলো; বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ও সাফল্যের বিজয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাদের নিয়ে গঠিত মিত্র-বাহিনীর কাছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রায় এক লক্ষ সেনাসদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে, জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার সেই ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেই থেকেই- “স্বাধীনতা” শব্দটি আমাদের। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালবাসা এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেম। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে -‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কার সাথে বৈরিতা নয়।’ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক এজন্য প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের সকলকে কাজ করে যেতে হবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে যোগ্য তনয়া শেখ হাসিনার ভিশন ২১, ভিশন ৪১, ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের জন্য আমি বিশ্বাস করি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত যোগ্যভাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলছে।