ড. কাজী এরতেজা হাসান
মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। ক’দিন ধরেই আশঙ্কা করা হচ্ছে শীতেই দ্বিতীয়বারের মত করোনা দেখা দেবে। অনেকে এ কথায় দোলাচলে ছিলেন। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যে আঘাত হানতে শুরু করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য বলে সবাই মনে করছেন।
এ ব্যাপারে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে স্পষ্টভাবে বলেছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিয়েছে। তবে দুঃখজনক হলো, খোদ রাজধানীতেই বহু মানুষ মাস্ক পরছে না। মাস্ক ছাড়াই তারা বাইরে বের হচ্ছে। অবশ্য যারা মাস্ক না পরে বাইরে চলাচল করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীতে এটি শুরুর আগেই দেশের অন্যান্য মহানগরে মাস্ক না পরা লোকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে নামে। গতকাল রাজধানীতে মাস্কবিহীনদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে। এসময় বেশ কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়। দেশব্যাপী মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের যে অভিযান চলছে, একে আমরা সাধুবাদ জানাই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে সুরক্ষা পেতে সবারই মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব হলে দৃঢ়ভাবেই বলা যায়, করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে ইতোমধ্যে ফের করোনা দেখা দেওয়ায় সেখানে নতুন করে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ কারণে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার দেশের সবাইকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন এবং এর মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। সরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা রোগীর সেবায় যে সব যন্ত্রপাতির প্রয়োজন তারও যোগান দেওয়া হয়েছে আগে থেকেই। করোনার প্রথম ধাক্কায় গোটা দেশের মানুষ বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তবে ধীরে ধীরে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, করোনার প্রথম ধাক্কা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। যা বিশ্বজুড়ে নজির সৃষ্টি করেছে। অনেক উন্নত দেশ দ্রুততার সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিচলিত না হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে এই মহামারি মোকাবিলা করেছেন। করোনায় বিধ্বস্ত পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে সক্ষম হন। দিনমজুর থেকে শুরু করেন শ্রমিক, কর্মচ্যুতদের খাদ্য এবং আর্থিক সাহায্য দেন। ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল আকারের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার।
যাই হোক করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সরকার সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। জাতীয় সংসদে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন, এটাকে মনে রেখে কাজ করতে হবে। মাস্ক পরা ছাড়া বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না কারোরই। এখন আবার সেকেন্ড ওয়েভ ব্যাপকভাবে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে বা যেটা নিয়ে রিসার্চ চলছে, আমরা আগাম বুকিং দিয়েছি। যাতে সেটা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমরা আনতে পারি। সে ব্যাপারে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছি। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানাই। ভ্যাকসিন আসছে, তা নিয়ে নানা গবেষণা চলছে। আমরা আগাম টাকা দিয়ে রাখছি। যখনই বাজারে আসবে আমরাও পাব। এখন মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। যেখানে বেশি লোকজনের সমাগম সেখানে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরবেন, সেটাই আমি সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি এবং গরম পানি খাওয়া, একটু গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করা, সব সময় হাত ধুয়ে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা অর্থাৎ স্বাস্থ্য সুরক্ষা রাখার নিয়মাবলি সবাই যেন ভালোভাবে মেনে চলেন।’
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ অন্যান্য ব্যাপারে সরকার প্রধান যা যা বলেছেন, তা সবার কল্যাণের কথা ভেবে বলেছেন। এদিকে করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে সরকার এগিয়ে আছে। এ ব্যাপারে সরকারের তীক্ষè নজর রয়েছে। সরকার ভ্যাকসিন পেতে, ‘এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে আগাম ভ্যাকসিন অর্ডার দিয়েছে। ফলে আশা করা যায়, ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা হবে না।
পরিশেষে বলতে চাই, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কাকে হেলাফেরার দৃষ্টিতে কারোরই দেখার সুযোগ নেই। একে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। দেশের মানুষকে মাস্ক পরার ব্যাপারে আরো আগ্রহী হয়ে উঠতে হবে এবং এটা নিজেদের করোনাঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখার স্বার্থে। এদিকে গতকাল দেশের একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অনেক সু-খবর রয়েছে। বিশ্ববাসী করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অধীর আগ্রহে সু-খবরের অপেক্ষায় ছিলেন। করোনা ভ্যাকসিন গবেষক এবং সংশ্লিষ্টরা সবাইকে আশ্বস্ত করে সেই সুখবরই দিয়েছেন। ফাইজার-বায়োএনটেকের দাবি, তাদের টিকা করোনা রোধে ৯৫ শতাংশ সক্ষম। অক্সফোর্ড জানিয়েছে, তাদের ভ্যাকসিন ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করছে। মডার্নার টিকা ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ, রাশিয়ার টিকা ৯২ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এগিয়ে চলেছে ভারত, চীনের টিকার হিউম্যান ট্রায়ালও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০টি কোম্পানির ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং হিউম্যান ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে ১০টি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের তৈরি তিনটি ভ্যাকসিনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন প্রি-ক্লিনিক্যাল ক্যান্ডিডেটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। দেশের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ফাইজার-বায়োএনটেক তাদের টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে জানিয়েছে। ভালো অগ্রগতি আছে অক্সফোর্ড আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন, মডার্না ও সিনোভ্যাকেরও। তবে ফাইজারের ভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে সফল হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি ভ্যাকসিন করোনা রোধে ৯৫ শতাংশ সক্ষম। তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। সব ঠিকঠাক চললে বড়দিনের আগেই বাজারে আসবে তাদের ভ্যাকসিন। মার্কিন ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা ফাইজারের সঙ্গে এই ভ্যাকসিন তৈরিতে সহায়তা করছে জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক।
ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ব্যাপক আকারে তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ‘কোভ্যাকসিন’ এর তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। ভারতে পরিচালিত সর্ববৃহৎ কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সংস্থাটি মোট ২৬ হাজার অংশগ্রহণকারীকে তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ভারত বায়োটেকের নির্বাহী পরিচালক সাই প্রসাদ গত মাসে বলেছিলেন, সংস্থাটি আগামী বছর জুনের মধ্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনটি চালু করার পরিকল্পনা করেছে। কার্যকারিতার তথ্য যদি ইতিবাচক হয়, তবে এটি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে চালু করা হতে পারে। তাহলে এটি সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ডের পর ভারতে চালু হওয়া দ্বিতীয় টিকা হবে। রাশিয়ায় কোভিড-১৯ এর টিকার যে ট্রায়াল চলছিল তা ৯২ শতাংশ সফল বলে প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে। এই ট্রায়ালে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের এক অংশকে স্পুটনিক ফাইভ নামের এই টিকা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে ২০ জনের শরীরে এই টিকা ৯২ শতাংশ সফলতা দেখিয়েছে। স্পুটনিক ফাইভ টিকা তৈরি করা হয়েছে মস্কোর এপিডেমিওলজি ও মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এসব ভ্যাকসিনের কোটি কোটি ডোজের ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাজ্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনের ১০ কোটি ডোজ, ফাইজার-বায়োএনটেকের ৪ কোটি ডোজ এবং মডার্নার তৈরি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের ৫০ লাখ ডোজ কেনার জন্য চুক্তি করেছে। পরিশেষে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের করোনা মোকাবিলায় তিনি যে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন, তা এক কথায় তুলনাহীন। তিনি করোনা প্রাদুর্ভাবে দেশের মানুষের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন, তা বিশ্বের অন্য কোনো সরকার তা করেছে কিনা আমরা জানি না। এছাড়া তিনি করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে তিনি রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। কোনোভাবেই যে এই দ্বিতীয় ধাক্কায় বড় কোনো বিপর্যয়ের সৃষ্টি না করতে পারে তার জন্য যেমন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। ভ্যাকসিনের যে সুসংবাদ রয়েছে, তার সুফল পেতে দেশের মানুষকে নিরাশ হতে হবে না। তাই বলা যেতেই পারে ভ্যাকসিন পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।