বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি, তথা অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীত চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম পর্যায়ের আক্রমণ। এ কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। এই করোনাকালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য। সেজন্যই আজ বাংলাদেশের অবস্থান একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৬৩ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। শুক্রবার (২০ নভেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক, সাবেক সচিব, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নির্বাহী চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জার্মান বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি আনোয়ারুল কবির। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ফারুক হোসেন বলেন, এটি স্বীকার করতে হবে যে করোনাকালে দেশের অর্থনীতি একটি বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। একমাত্র চীন বিরাট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির মধ্যে আছে তাছাড়া বিশ্বের বাকী সব দেশ নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যে কয়টি দেশ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পজিটিভ ইঙ্গিত দিচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ যে, এতো দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ একটি ভালো অবস্থানে আছে। এর সাথে এটিও স্বীকার করতে হবে এই করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে দেশীয় উৎপাদন সংকুচিত হবে এবং কর্মহীন হবে কোটি কোটি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলায় যেভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছেন তাতে আশা করা যায়, তাঁর নিরলস পরিশ্রম ও অদম্য মনোবলের কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই করোনা মোকাবলোয় বাংলাদেশ ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে। করোনাকালীন দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে রেমিটেন্স প্রধান ভূমিকা রাখলেও পাশাপাশি পিছিয়ে নেই তৈরি পোশাক খাত শিল্পটি। করোনার থাবায় যেখানে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও নিজেদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আশার আলো দেখিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। বিশ্ব ব্যাংক, আইডিবি ও আইএমএফ এই তিনটি সংস্থায় কিন্তু বাংলাদেশের জন্য আশার বানী শুনিয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে আশাজাগানিয়া সংবাদ আমাদের আন্দোলিত করে। তাদের বক্তব্যে প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং কোভিড চলাকালীন সময়ে এবং এর দ্বিতীয় ঢেউ এর প্রাক্কালে আমরা ভালো একটা সম্ভাবনার বানী পাচ্ছি এইসব ডেভোলপমেন্ট পার্টনারদের কাছ থেকে। আমরা বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি ৫.২৪% চলতি অর্থবছরে ৮.২% আশা করছি। এই যে প্রত্যাশা করছি এটা হয়তো অনেকের কাছে উচ্চবিলাসী মনে হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের সরকার বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা যে অদম্য চেষ্টা আছে তার কারণে আমরা দেখতে পারছি এই পুরো করোনাকালে আমাদের অর্থনীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। জনসংখ্যার সুবিধার জানালায় আমরা আছি এবং এটিকে যদি আমরা কাজে লাগিয়ে আমরা ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরে, আত্মকর্মসংস্থানে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আরও একটি চমৎকার ফলাফল আসবে। এর যে ফলাফল আসবে তাতে নানাভাবে আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব আসবে।
অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের সব সম্ভাব্যের দেশ। একটা সময় ছিল বাংলাদেশকে বলা হতো জনম দুঃখীর দেশ। সেই অবস্থান থেকে একটি অপার সম্ভাবনার দেশে রূপান্তরিত হবার যে একটি প্রক্রিয়া তার যে পূর্ণ উদ্যমে ছুটে চলা অবস্থায় ছিলাম সে রকম একটি মুহূর্তে এই করোনা নামক মহামারি আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রতিবারের মতই আমরা যেরকম প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যে সমস্যায় হোক না কেন আমরা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছি এবারো আমরা এই করোনার প্রকোপকে ঠেকাতে অনেকটায় সক্ষম হয়েছি। এই বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও আমরা কিন্তু থমকে দাড়ায়নি। আমাদের যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তা আমাদের গড়ে দাড়াতে সক্ষম করেছে এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে আমাদের অর্থনীতি গতিশীল আছে এমনকি করোনা উত্তরণ কালে ব্যাপক অর্জন করতে সক্ষম হবো এইরকম একটি সম্ভাবনাও আমরা দেখতে পারছি। করোনা পূর্ব কালে রাজনীতিতে যে একটা শুদ্ধি অভিযান চলছিলো এটা কিন্তু এখনো অব্যাহত আছে। এর ফলে লুটেরা দুর্বৃত্তায়নের যে একটা প্রক্রিয়া চলছিল এটাকে একবারে দমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী উৎযাপন উপলক্ষে যে পরিমাণ চিন্তাভাবনা করেছিলাম, তাতে কিন্তু করোনার কারণে একেবারে হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকিনি। তার যে দর্শন ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের বড় বড় এবং শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর সরকার প্রধানদের কপালে দুশ্চিন্তার কালো ছাপ স্পষ্ট। এটা যতটা কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যার এবং এর ফলে মৃত্যুহারের ঊর্ধ্বমুখীর জন্য, ঠিক ততটাই অর্থনীতিতে মহামন্দার আশঙ্কা নিয়ে। করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটবে অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই দ্রুত। আমদানি-রফতানি ব্যয়ে ভারসাম্য, রেমিট্যান্সে সাফল্য, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দীর্ঘদিন পর চাঙ্গা হয়েছে পুঁজিবাজার এবং জিডিপি অনুপাতে সরকারি ঋণ কম হওয়ায় অন্য দেশের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে আগামী অর্থবছরেই স্বাভাবিক হচ্ছে অর্থনীতি। সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এমন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আর এমন পূর্বাভাসের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরাও। আমরা যে বেঞ্চমার্ক ধরে নিয়েছি ২০৪১ সালে আমরা একটি উন্নত অবস্থানে যেতে সক্ষম হবো, যেটা আমাদের অবশ্যই ধরতে হবে সে লক্ষে আমরা করোনাকালেও না থেমে অসীম সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
আনোয়ারুল কবির বলেন, আমাদের এখানে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা খুবই মর্মান্তিক। প্রত্যেকদিন জার্মানিতে ২০-২৫ হাজার নতুন লোক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। হয়তো বা আপনারা এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পারছেন। ফ্রান্সের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এখানে ব্যবসার অবস্থার আরও ভয়াবহ। এখানে যদি সরকার প্রণোদনা না দিত তাহলে এই ৮-৯ মাস পর্যন্ত হয়তো টিকে থাকতে পারতাম না। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই জার্মানিতে এখান থেকে উত্তরণের বিষয়টা খুব দুরহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো ১৭ কোটি জনসংখ্যা জার্মানিতে হলে দেশটির কী হতো বলা মুশকিল, তবে এটা বলা যায়, জার্মানিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে যতজন লোক বসবাস করে, রাজধানী ঢাকার একটি মহল্লায় তার অন্তত ২০ গুণ বেশি লোক বসবাস করে। সে হিসেবে, জার্মানির করোনা মোকাবেলা আর বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলাকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়। এতসব সুবিধা নিয়েও মার্কেল ও জেসিন্ডা করোনা মোকাবেলায় যেভাবে সামাল দিয়ে যাচ্ছেন, সীমিত আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে তা মোকাবেলা করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কারণে গত এক দশকে বাংলাদেশে গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ইতোমধ্যে ৮ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরেই অর্জিত হয়েছে। করোনার মধ্যেও দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫৫ ডলার। এই করোনা কালেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে; এই ব্যাপারে কারও মধ্যে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।