টানা ৩১ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় নরকে পরিণত হয় সিলেটের জনজীবন। হাসপাতাল, জরুরি সেবা, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট সেবা তো ব্যাহত হয়েছেই, পানির জন্য নাভিশ্বাস উঠেছে নগরবাসীর। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে এই সমস্যায় পড়ে সিলেটের বাসিন্দারা। সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের কিছু এলাকাতেও বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা যথেষ্ট না থাকায় ক্ষোভ দেখা দেয় সচেতন সিলেটবাসীর মধ্যে।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই পুরো নগরজুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। রাত বাড়ার সাথে সাথে অন্ধকার নগরী ফাঁকা হতে থাকে। রাস্তাঘাট ও বিপনীবিতানগুলো থেকে লোকজন কমতে শুরু করে। কমে যায় নগরীতে যান চলাচল। টানা বিদ্যুতহীনতায় বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুৎ না থাকায় দুপুর থেকেই বাসা-বাড়ি, মসজিদসহ নানা স্থানে পানিসহ নানা সংকট সৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের অভাবে অনেক গৃহস্থালী কাজ ব্যাহত হয়।
যাদের জেনারেটরের আলো পাবার সামর্থ নেই মোমবাতি আর চার্জার লাইটে গতকাল রাতটা কোনোক্রমে পার করেছেন তারা। পানির সংকট প্রকট হয় সকাল থেকে। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যেতে না পেরে অনেকে বেরিয়েছেন পানির সন্ধানে। আজ বুধবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লার পুকুর ও জলাশয় থেকে প্রতিযোগিতা করে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় নগরবাসীকে। বিশেষত বস্তি এলাকার লোকজনের মধ্যে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়।
আম্বরখানা এলাকায় বাসিন্দা রহিম মিয়া বলেন, ‘কারেন্ট নাই, পানি নাই, গোসল খাবার কিছু নাই। জীবন পুরো নরক হয়ে গেছে।‘ দুপুর ১২টায় কলবাখানি থেকে সপরিবারে শাহী ঈদগাহ পুকুর থেকে পানি সংগ্রহে আসেন জমিলা খাতুন নামের এক নারী। কিন্তু ঈদগাহের গেট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন তিনি। একে একে তার মতো আরও অনেক মানুষ জড়ো হলে ঈদগাহ কর্তৃপক্ষ গেট খুলে গোলস ছাড়া শুধু পানি সংগ্রহের সুযোগ করে দেন।
যেখানেই পানি পাওয়া গেছে সেখানেই লেগেছে দীর্ঘ লাইন। দুরাবস্থায় এগিয়ে এসে অনেকে জেনারেটরের সাহায্যে পানি তুলে মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছেন। এখানে পানি সংগ্রহ করতে আসা সেলিম শিকদার বলেন, সিলেট এতটাই অবহেলিত যে দুদিন ধরে বিদ্যুৎ নাই। সিটি করপোরেশনও কোনো পানি দিচ্ছে না।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এমন সময় পানি দিতে না পারলে সিটি কর্পোরেশন আর কী সেবা দিবে?’
বুধবার রাত আটটায় কিছু কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।সিলেট বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. মোক্কামেল হোসেন জানান, নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। তবে পুরো এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
বিদ্যুৎ না থাকায় ক্রেতাদের উপস্থিতি কম ছিল বিপনীবিতানগুলোতে। একনাগাড়ে জেনারেটর চালিয়ে ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সেবা দিতে পারছিল না।
সিলেট সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর জানান, নগরে প্রায় ৮ লাখ বাসিন্দার দৈনিক পানির চাহিদা রয়েছে ৮ কোটি লিটার। এর মধ্যে ৪ থেকে ৫ কোটি লিটার সিটি কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে পারে। যদিও নগরে সাড়ে ৫৪ হাজার হোল্ডিংয়ের মধ্যে পানির গ্রাহক রয়েছেন সাড়ে ১৬ হাজার। বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লাগার আগে প্রায় ১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা গেছে। এ অবস্থায় নগরবাসী হঠাৎ করে তীব্র পানির সংকটে পড়েন। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না জানিয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরে মাইকিং করা হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, আজ বেলা ২টার দিকে গাজীপুর থেকে পাওয়ার ট্রান্সফরমার এসে সিলেটে পৌঁছায়। নতুন পাওয়ার ট্রান্সফরমার বসানোর পর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। তবে সেখানেও ব্যাঘাত হতে পারে।
দুটি পাওয়ার ট্রান্সফরমার-এর জায়গায় একটি দিয়ে আপাতত বিদ্যুৎ চালু রাখার চেষ্টা চলছে। তাই বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে ফ্রিজ, মটরসহ ভারি ইলেকট্রনিক সামগ্রী চালু না করার আহবান জানিয়েছেন পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মোকাম্মেল হোসেন।
তদন্ত কমিটি :
বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) সিলেটের কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ উপকেন্দ্রে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনস্থাল পরিদর্শন করেছেন। আজ বুধবার বিকেলে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পিজিসিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কীভাবে হলো, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটির সদস্যরা বুধবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে এ ঘটনায় এখনো কাউকে দায়ী করা হয়নি এবং কাউকে শাস্তিও পেতে হয়নি।
এর আগে, সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত কমিটিকে তিনদিনের মধ্যে নির্বাহী পরিচালক (ওএন্ডএম) পিজিসিবি বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
পিজিসিবি’র নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুম আলম বকসী জানান, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (ট্রান্সমিশন ২) প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল হককে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বি এম মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ ফয়জুল কবির ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (শ্রীমঙ্গল) নির্বাহী প্রকৌশলী আব্বাস উদ্দিন।