* অধীনস্তদের দিয়ে হাতানো টাকা পাঠানো হচ্ছে বিদেশে
* গোপনেই চলছে পাচার-কারবার
* অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
* অপরাধী সরকারি কর্মকর্তা গ্রেফতারে লাগবে না অনুমতি
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েই মাঠে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে নিজ দলের দুর্নীতিপরায়ন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দুর্নীতি থেকে নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু সে উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আমলাতন্ত্রই সরকারের জন্য বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন তথ্য দিয়েছেন, বিদেশে অর্থপাচারকারীদের বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিনি বলেন, ‘কানাডায় খবর নিয়েছি, প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি, মনে করছিলাম, রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেলো রাজনীতিবিদ মাত্র চারজন। অর্থপাচারে জড়িতদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি।’
এক তথ্যসূত্র বলছে, অর্থপাচারসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের হাতিয়ার হিসাবে সরকারি বড়কর্তারা তাদের অধীনস্ত ছোট পদের চাকরিজীবীদের ব্যবহার করে আসছে। তারাই দফতরের শীর্ষকর্তাদের নাম গোপন করে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন বড়কর্তাদের পকেটে। সেই টাকা গোপনে পাচার হচ্ছে বিদেশে।
ইতোমধ্যে অনেক আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সত্যতা মিলেছে। তাদের অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। কারো কারো বিচারও চলমান। তবে বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে বায়বীয় তথ্য থাকলেও মিলছিল না প্রমাণ। অপরাধীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের চোখে ধুলো দিয়ে কিংবা ম্যানেজ করে পার পেয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থপাচারের অভিযোগের তীর চলছিল রাজনীতিবীদদের দিকে। বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দিকে চলা সেই তীর গতকাল বুধবার ঘুরে গেল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিকে। বিষয়টি খোলসা করলেন খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুপুরে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বিদেশে অর্থপাচারে জড়িতদের তথ্য তুলে ধরে তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, ‘অবৈধভাবে পাচার করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে ১৫৪ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পরও দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। অথচ দুর্নীতি কমাতে পাঁচ বছর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল সরকার। অন্যদিকে ডাক বিভাগেও চলছে ডিজিটাল ডাকাতি। গ্রামের জনসাধারণকে ডিজিটাল সেবা দেওয়ার কথা বলে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন বিভাগটির মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, গত পাঁচ বছরে গ্রেফতার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯৭ শতাংশই সরকারি। সরকারের বিভিন্ন খাতে এসব দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে রয়েছে অর্ধশত কমিটি। অথচ আইনের ফাঁক গলে পাড় পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে।
দুদকের এক তথ্যে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির অভিযোগে যত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে, তার অর্ধেকই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রেফতার ৭৯৯ জনের ৩৯০ জনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাকিদের মধ্যে ১৫৪ জন বিভিন্ন ব্যাংকের। দুদকের অপর এক তথ্য বলছে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ২৫ দল গঠন করেও থামানো যাচ্ছে না অনিয়মের মিছিল। এছাড়া সরকারি দফতর ও সেবা সংস্থাগুলোতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৫টি মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে পাওয়া গেছে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য।
দুর্নীতির এ খাতে রয়েছে সরকারি বড় বড় প্রায় সব দফতরই। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ আরও বেড়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (কাস্টমস উইং) এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ, পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদফতর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও আবাসন অধিদফতর, স্ব^াস্থ্য মন্ত্রণালয়/অধিদফতর এবং বিদ্যুৎ ও পানি সম্পদ (পিডিবি, পাউবো, ডেসকো, ডিপিডিসি, ওয়াসাসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই অভিযোগ পড়ছে কমিশনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার ৭৯৯ জনের অর্ধেক যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়, উল্টো দিকেও তো অর্ধেক আছে।’ তবে তিনি অর্থপাচারের বিষয়ে কোন কথা বলেননি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ‘অর্পিত ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভ অর্জনই দুর্নীতি।’ বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘পাবলিক অফিসের অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভই দুর্নীতি।’ টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘এই ধরনের খাতগুলোকে আগে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেখানে চুনপুটিকে ধরার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।’ তিনি জানান, অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারি পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকাই দুর্নীতি বাড়ার বড় কারণ। তিনি আরও বলেন, ‘সিস্টেম জনবান্ধব হলে ব্যক্তি কখনো মুখ্য হয় না। মানুষ যখন কাজের জন্য এসে দেখে, দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে, তখনই সে অন্ধকার পথ খোঁজে।’ এদিকে অর্থপাচারে জড়িত সরকারি বড় কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনতে আইনি বাধা আছে কি না এমন প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ভোরের পাতাকে বলেছেন, ‘দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো ফৌজদারি অপরাধ করলে, তাকে গ্রেফতারে আইনে কোনো বাধা নেই। গ্রেফতার করতে সরকারের কোনো অনুমতিও লাগবে না।’