মোহাম্মদপুরের কুখ্যাত ভুমিদস্যু ও চাঁদাবাজ মনিরুজ্জামান মনির ওরফে কালা মনির ওরফে ইয়াবা মনির। অতি সম্প্রতি সে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর কারাবন্দি হলেও থেমে নেই তার চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য। তার অবর্তমানে দখল বজায় রাখতে কাজ করছেন তারই মা লেডি মাস্তান সাবিহা বেগম। মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা ভয়ঙ্কর এই নারী এতদিন পেছনে থেকে ছেলের সব অপকর্মে সমর্থন জোগালেও এবার প্রকাশ্যে এসে পুরো বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছেন। মনিরের অর্ধশতাধিক ক্যাডার ও দখলবাজ বাহিনীর কমান্ড এখন তার হাতে। এ কারণে ঢাকা উদ্যানবাসীর কাছে ‘লেডি মাস্তান’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন তিনি।
কালা মনিরের নানা অপকর্ম নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
মনিরুজ্জামান মনির কারাবন্দি থাকলেও তার দখল করা একটি প্লটে বাড়ি বানানোর কাজ চলমান। এই জমিতে স্থাপনা তৈরিতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মনির বাহিনীর সব অপকর্মে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিতর্কিত এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ভুক্তভোগী বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কে এম মোস্তফা নাজিমের অভিযোগ, মনির বাহিনী তার জমি দখল করে নেয়ার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলেও কোন ফল পাননি। তিনি বলেন, ‘ডিসি সাহেব জমি উদ্ধারে আইনি সহায়তা করেননি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, শ্লীলতাহানির মামলা হয়েছে। গত ৬ ও ৮ নভেম্বর দুই দিনের ব্যবধানে আমার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। একটি মামলার বাদী কালা মনিরের মা সাবিহা বেগম। অন্য মামলার বাদী মনিরের অফিস সহায়ক ৭০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল হাই। ডিসি সাহেবের অনুমতি নেয়া ছাড়া কি এমন মামলা থানা নিতে পারে? তবে দুটি মামলার শুনানি শেষে প্রথম দিনই আদালত আমাকে জামিন দিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত হয় মামলা দুটি মিথ্যা।’
এদিকে, কারাবন্দি হওয়ার পর মনিরের অপরাধ সাম্রাজ্য ঢাকা উদ্যান সরেজমিনে গিয়ে পাওয়া গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। বছিলার বাসিন্দা মনিরের চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যর শিকার আজাহার এন্টার প্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী বরকত উল্লাহ জানান, মনিরের অপরাধ সাম্রাজ্যের হাল ধরেছেন তার মা নিজেই। পিসি কালচার হাউজিংয়ে তার ছয় তলা বাড়িতে পরিবার পরিজন রেখে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে তিনি অবস্থান নিয়েছেন ঢাকা উদ্যানের বাগান বাড়িতে। ইতোমধ্যেই যে বাড়ি মনিরের টর্চার সেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মিডিয়ায়। রাত দিন এই বাগান বাড়িতে থেকেই মনিরের সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করছেন তিনি।
ঢাকা উদ্যানের একাধিক লোকের সাথে কথা বলতে গেলে তাদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ দেখা গেছে। তাদের ধারণা এর আগেও মনির দু’বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই তিনি দু’বারই জামিনে বেরিয়ে ফের দাপট দেখিয়েছেন।তখনও গ্রেপ্তারের পর যারা মনিরের অপকর্ম নিয়ে মিডিয়ায় মুখ খুলেছিলেন তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছিল। তাই এবার সবাই সতর্ক। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলেছেন, মনির বাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মাসুদ ওরফে ম্যানেজার মাসুদ, খালেদ ওরফে হোন্ডা খালেদ ওরফে কাইল্যা খালেদ, মিজান ওরফে জামাই মিজান, শুভ, অলি ওরফে বাবা অলি, নান্টু ওরফে বিহারী নান্টু, পাপ্পু তালু ডলা পাপ্পু, রিয়াজ ওরফে মামা রিয়াজসহ অর্ধশতাধিক ক্যাড়ার। চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে কাজে লাগালো হচ্ছে বিহারী ক্যাম্পের লোকজন। আবার মনিরকে ভাল লোক প্রমাণ করতে তারা টাকার বিনিময়ে বিহারী ক্যামের ৪-৫শ’ লোক জোগাড় করে মানবন্ধনও করেছেন বলে জানান ভূক্তভোগীরা।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পরিচয়ে মনিরকে ভাল প্রমাণ করতে গিয়ে মহান এই খেতাবে কালিমলিপ্ত করছেন তারা।
মনির বাহিনীর ভয়ে ঢাকা ছেড়েছেন সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য সুবল দাস ও রাজন দাস। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে ঢাকা উদ্যানে এসে বরকত উল্লার মালিকানাধীন আজাহার এন্টারপ্রাইজে চাকরি করতেন তারা। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সুবল দাস বলেন, ‘মনির বাহিনীর সদস্যরা এর আগে আমাকে তুলে নিয়ে বাগান বাড়িতে আটকে বেদম মারধর করে ধর্মন্তরিত করার চেষ্টা করেছিল। আমাকে কালেমাও পড়িয়েছিল। তখন পত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও মনিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।এবার মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পর মনিরের মা ও তার অফিসের পিওন আমার বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আজহার এন্টারপ্রাইজে চাকরি করাই আমার অপরাধ। এই প্রতিষ্ঠানের কারণে মনির একটি প্লট তার দখলে নিতে পারছেনা।এসব কারনে ভয়ে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।’
সোমবার দুপুরে ঢাকা উদ্দ্যানের দিল মোহাম্মদ এভিনিউ রোডে গিয়ে দেখা যায়, মুল সড়কের পাশেই একটি প্লটে উচু ভবন নির্মানের কাজ চলমান। জানা যায়, সি ব্লকের এই প্লটটির মালিক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কে এম মোস্তফা নাজিম। তিনি বলেন, চলতি বছরে বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে মনির তার কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে গত ২০ আগস্ট মনিরের ক্যাডার বাহিনী তার বাড়ির নির্মাণসামগ্রী লুট করে। তার অভিযোগ, তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্লটটির দখল নিয়েছিলেন মনির।এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমি বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবো। এরপর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাবো।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সাবিহা বেগম বলেন, মাত্র ৫ কাঠা জায়গা দখল কেন করতে হবে? আপনাদের কমনসেন্সের অভাব আছে। আমার ছেলে (কালা মনির) ভালো মানুষ বলেই তার পিছনে শত্রু লেগেছে এবং র্যাব দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে।