সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট পরি্কল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের নিজ এলাকায় নিয়ে যাওয়া বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। এবার পরিকল্পনামন্ত্রীও তিলেন তার বক্তব্যের কড়া জবাব।
সোমবার (১৬ নভেম্বর) বিকালে জগন্নাথপুর পৌরসভায় পানি সরবরাহ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ওভারহেড ট্যাংক ও ড্রেনেজ কাজ ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করার সময় দেওয়া বক্তৃতায় এমন মন্তব্য করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। মন্ত্রীর দেওয়া এমন বক্তব্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ অক্টোবর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো মেগা প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের নিজ এলাকা শান্তিগঞ্জের দুই কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনের প্রতিবাদে জেলা সদরে বিশাল মানববন্ধন করেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের হুইপ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক ও মানুষের ক্ষোভ নিরসনে জরুরি সভা ডেকে সদর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জে সীমানায় দেখার হাওরের পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের প্রস্তাব করে রেজুলেশন করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। রোববার রেজুলেশনের কপি দলীয় প্যাডে লিখিত আকারে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
পীর মিসবাহকে উদ্দেশ্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জের কাছে খোলা সুন্দর জায়গায় আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি। অনুমোদন আমি করতে পারি না। আমার ক্ষমতা নেই। পীর মিসবাহকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কিন্তু একজন ব্যক্তি বিরুদ্ধে লেগেছেন, তিনি ঘটনাচক্রে সংসদ সদস্য। নরমাল নির্বাচন হলে তাঁর আসার কথা নয়। আমাদের দল কৌশলগত কারণে সদরের এই আসনটা (জাপাকে) দিয়েছিল। ফলে তিনি ঘটনাচক্রে এখানের এমপি। আর ঘটনাচক্রের এমপি বলে, আমরা যেখানে (জনগণের) দরজায় গিয়ে কান্নাকাটি করে হাত-পা ধরে ভোট আনি, তাকে কিছুই করতে হয় নাই। আওয়ামী লীগ সরে গেছে, তিনি অটোমেটিক হাওয়ায় এমপি হয়ে গেছেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (পীর মিসবাহ) বলেন, এটি সদরে হতে হবে। কেন? সদর আর দক্ষিণ সুনামগঞ্জে কত দূরত্ব। সদর যেখানে শেষ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ সেখানে শুরু। আমরা এটিকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের এই জায়গায় করেছি, কারণ এটা সুন্দর জায়গা। মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস করতে হবে না। মাত্র তিনটি লন্ডনিবাড়ি সরাতে হবে। কোনো গরিব পরিবার নেই। এই জায়গা আমরা প্রস্তাব করেছি। এইটা নিয়ে এই এমপি সাহেব বলছেন, সেটা সদরে হতে হবে। কেন আমরা এটা বুঝি না? সদরে হলে, তিনি বলবেন, হ্যাঁ সদরবাসী দেখেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় এনেছি।’
মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আরে ভাই, এই বিশ্ববিদ্যালয় আসার আগে কোনো একদিন আপনার মুখ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দ বের হয়েছে দেখান? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাদ দেন, এ নিয়ে কোনো মন্ত্রী, সচিব কিংবা ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আপনি অনুরোধ করেছেন? হাত পেতেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। আপনি সদরবাসীকে বলতে চান, আমি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এসেছি। আমি একজন বড় এমপি। এইভাবে বড় নেতা হওয়া যায় না।’
মন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুল রহমান মিসবাহ বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জ জেলা সদরকে বঞ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অনেকগুলো মেগা প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকায় নিয়ে যাওয়ায় জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যৌক্তিক প্রতিবাদ করেছিলাম আমি। সেইসভায় মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে আমাদের দাবির কথা জানিয়েছিলাম। তাকে হেয়প্রতিপন্ন করে একটি শব্দও বলা হয় নাই। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী যেভাবে আমার বিরুদ্ধে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে আক্রমণাত্মকভাবে যা খুশি বলেছেন, সেটা দুঃখজনক। তাঁর বক্তব্য সরকার ও জোটের নীতির পরিপন্থী। আমি এর নিন্দা জানাই। আমি সব সিনিয়রদের সম্মান করে বড় হয়েছি। তাকে অসম্মান করব না কিন্তু তিনি যত প্রতিশোধই নেন না কেন আমি জনগণের পাশে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাইতে ভুল করবো না।
পীর মিসবাহ আরো বলেন, ‘মন্ত্রী বলেছেন সুনামগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আমি কোনো আওয়াজ তুলিনি। এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য, তিনি হয়তো সংসদে নিয়মিত নন বা মনোযোগী থাকেন না। দুই টার্মে সংসদে আমি অসংখ্যবার সুনামগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ, সেতু, শিক্ষক সংকট নিয়ে সোচ্চার ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে আলাপ করে আবেদন করে, সুরমা নদীর ওপর নির্মিত সেতু গণমানুষের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুজ জহুরের নামে করিয়েছি। তিনি ক্ষমতাবান মন্ত্রী হয়ে মরহুম জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্য কি করেছেন?
প্রধানমন্ত্রীর উপহার সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা শান্তিগঞ্জে স্থাপিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এমন পরিবর্তন আনায় বিক্ষুব্ধ সুনামগঞ্জবাসী তুমুল প্রতিবাদ জানান। পীর মিসবাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল মন্ত্রীও দেননি। সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। সদরে বিশ্ববিদ্যালয় সব উপজেলার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই চেয়েছি। মন্ত্রীর প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। সম্মান আছে। তিনি যেখানে সব প্রকল্প স্থাপন করতে চান, সেখানে কারা সর্বশেষ জায়গা কেনা-বেচার বাণিজ্য করছে সেটিও দেখতে বলেছি। পীর মিসবাহ মন্ত্রীর আক্রমণের জবাবে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, আমি বড় এমপি বা নেতা এমনটা কখনো দাবি করিনি। মানুষের কর্মী ও সেবক হিসেবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। মন্ত্রী মহোদয় সারাজীবন সরকারি চাকরি করে অবসরে এসে আজ বড় ক্ষমতাবান মন্ত্রী হয়েছেন। এটা আমাদের গর্ব। রাজনীতিবিদরা যেখানে সারাজীবন রাজনীতি করে কিছু হতে পারেন না সেখানে তার অর্জনে আমরা সুনামগঞ্জবাসী আনন্দিত। অনুরোধ মানুষের মনের ভাষা বুঝবার চেষ্টা করবেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিআরটিএ অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার, যুব মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মতো প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সবগুলো মেগা প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা শান্তিগঞ্জের দুই কিলোমিটার ব্যাপ্তির মধ্যে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় আশাহত হন জেলাবাসী। বিশ্ববিদ্যালয়টি জেলা সদরে স্থাপনের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয় সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহর নেতৃত্বে। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও এই দাবির পক্ষে পথসভা, স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থান, মানববন্ধন, মতবিনিময় ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।