চলে গেলেন কণ্ঠ ও অভিনয়ের জাদুকর সৌমিত্র চেট্টোপধ্যায় (জন্ম :১৯ জানুয়ারি ১৯৩৫, মৃত্যু-১৫ নভেম্বর ২০২০)
(প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক)
ভোরের পাতা ডেস্কহাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন একমাসেরও বেশি। এই মাসাধিককাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভক্তকূল কাটিয়েছিলেন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে। শেষ সময়ে তিনি যখন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় চোখ মেলেছেন বলে খবর এলো তখন যেন কিছুটা স্বস্থি ফিরেছিল। আশার আলো দেখেছিল সবাই। কিন্তু গতকাল রাতে তার অবস্থার অবনতি এবং ব্রেনডেথের খবর আসার পর অলৌকিক কিছুর আশার করছিলেন সবাই। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। সবাইকে কাঁদিয়ে সংসার ত্যাগ করলেন ‘অপু’। বাংলার কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পৃথিবীর মায়া থেকে নিলেন চিরবিদায়। গতকাল রোববার দুপুরে কলকাতদার বেলভিউ ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কিংবদন্তীর। সত্যজিত রায়ের অপু আর ফেলুদা চরিত্রকে রূপালী পর্দায় অমর করে দিয়ে চিরবিদায় নেওয়া পশ্চিমবঙ্গের এ প্রখ্যাত অভিনেতা ও বাচিকশিল্পীল বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে ভারত ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। কীর্তিমান এ বাঙালির চিরবিদায়ে কাঁদছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা রাজনীতিবিদসহ সব পেশার মানুষ; যারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছেন আর শুনেছেন তাকে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সৌমিত্রের উদ্দেশে লেখা শোকাথায় ভরে গেছে। সর্বস্তরের বাঙালি বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিভাবান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে অভিনয় জগতে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তিনি তার সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের কিংবদন্তী অভিনেত্রী ববিতা সহশিল্পী সৌমিত্রের মৃত্যুতে পরম শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর মৃত্যু হয় না; দর্শকদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল ছিলেন, আছেন, থাকবেন। কিংবদন্তী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করে দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিতি লাভ করেন সেই সময়ের ষোড়শী নায়িকা ববিতা। এদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে গতকাল দুপুরেই বেলভিউ গাসপাতালে ছুটে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমিত্রের মেয়ে পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেন। পৌলমী এসময় তার বাবার মরদেহ প্রথমে গল্ফগ্রিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা এবং পরে রবীন্দ্র সদনে সর্বস্তরের মানুষের শোক জানানো শেষে কেওড়াতলা শ্মশানে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের কথা জানান। সৌমিত্রের শেষযাত্রা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকা ‘এই সময়’ সন্ধ্যার দিকে তাদের অনলাইন ভার্সনে লিখেছে, সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে সৌমিত্র-হীন শহরে, চোখের জলে বাঙালি এগোচ্ছে কেওড়াতলার দিকে...।
বহু মানুষ রবীন্দ্র সদনে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। হাসপাতালের পর রবীন্দ্র সদনেও উপস্থিত হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টলিউডের বহু শিল্পীরাও সেখানে হাজির হন। চোখের জল মানছিল না কারও। গল্ফগ্রিনের বাড়িতে কিছুক্ষণ রাখার পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। সেখান থেকে যায় রবীন্দ্র সদনে। এরপর ক্যাওড়াতলা শ্মশানে গান স্যালুটের পর অনুষ্ঠিত হয় শেষকৃত্য।
সৌমিত্র কন্যা পৌলমী বসু বলেছিলেন, ‘দুঃখ করবেন না। আমার বাবার জীবন সেলিব্রেট করুন।’ এ দিন হাসপাতালের সামনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকার ও হাসপাতালের ডাক্তারদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। ধরা গলায় জানান তার বাবার শেষযাত্রার সফরসূচিও। আর তা জানতেই বিভিন্ন জায়গায় ভিড় জমায় বাঙালি। কেউ হয়ত একবার দেখতে চান, কেউ বা চান শেষযাত্রার সাক্ষী হতে। গল্ফগ্রিনের বাড়ি থেকে যখন সাদা ফুলে সাজানো শববাহী গাড়ি রবীন্দ্র সদনে এগিয়ে চলছিল তখন সকলের কণ্ঠে উঠে আসে, ‘আগুনের পরশমণি, ছোঁয়াও প্রাণে...’। তখন যেন এগিয়ে চলেছেন ‘অপরাজিত’, শেষ বারের মতো... লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের দুনিয়া থেকে বহু দূরে। ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর...।
করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় গত ৬ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল সৌমিত্রকে। প্রায় দশ দিন চিকিৎসার পর ১৬ অক্টোবর তার করোনাভাইরাস রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ আসে, শারীরিক অবস্থারও কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা থাকায় তার অবস্থার আবার অবনতি হতে শুরু করে। প্রস্টেটের পুরানো ক্যান্সারও আবার ফিরে আসে, সেই সঙ্গে ছিল শ্বাসতন্ত্রের পুরানো সমস্যা।
চার দিন আগে সৌমিত্রর শ্বাসনালীতে অস্ত্রোপচার করেছিলেন চিকিৎসকরা। এর মাঝেই শুক্রবার থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় সৌমিত্রের দেহ চিকিৎসায় আর সেভাবে সাড়া না দেওয়ায় অনেকটাই হাল ছেড়ে দেন চিকিৎসকরা।
একজন চিকিৎসক শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখান থেকে ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছি, এখন কেবল অলৌকিক কিছুই পারে তাকে এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে।’ কিন্তু সেই অলৌকিক ঘটনাটি আর ঘটল না, বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র যাত্রা করলেন অন্যলোকে। ১৯৩৫ সালে ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এক সাংস্কৃতিক পরিবাওে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় একজন আইনজীবী ও মঞ্চঅভিনেতা। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়ও যুক্ত ছিলেন মঞ্চনাটকে; তিনি স্থানীয় নাটকের দল ‘প্রতিকৃতি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
সৌমিত্রের স্কুলজীবন কেটেছে কৃষ্ণনগরের সেন্ট জোনস বিদ্যালয়ে। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ফাঁকেই নির্দেশক অহীন্দ্র চৌধুরীর হাত ধরে মঞ্চনাটকে তার অভিষেক। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লেয়ার’ অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা লিয়র’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন সৌমিত্র। অনেকের বিচারে সেটাই ছিল মঞ্চে তার সেরা অভিনয়।
সত্যজিত রায়ের ফেলুদা চরিত্রের রূপায়ন করে চলচ্চিত্র সমালোচকদের মনে স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুরুতে আবৃত্তি ও মঞ্চনাটকে ব্যস্ত সৌমিত্র চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তার মন বদলে দেয়। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’র অপু চরিত্রের জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সৌমিত্রের। সেই সূত্রে অডিশন দিতে গেলেও চরিত্রের সঙ্গে বয়সের তারতম্যের কারণে সেবার সুযোগ মেলেনি তার। তবে সৌমিত্রকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের। ১৯৫৯ সালে অপু ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এ তরুণ অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকেই তিনি বেছে নেন। সেই সিনেমায় সৌমিত্রের সঙ্গে অভিষেক ঘটে ১৩ বছর বয়সী শর্মিলা ঠাকুরের। সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’র মতো দৃশ্য আর সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সেই রসায়ন দর্শকের মনে এখনও অমলিন। সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর পর সত্যজিতের সৃষ্টি আরেক চরিত্র ফেলুদাকে সিনেমার পর্দায় সৌমিত্র নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনশর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই শিল্পী। মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, বাক্স বদল, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, ঝিন্দের বন্দী, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আবার অরণ্যের মত সিনেমার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে। অভিনয় ছাড়াও নাটক ও কবিতা লিখেছেন তিনি, যুক্ত হয়েছেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশনায়, দ্যুতি ছড়িয়েছেন আবৃত্তির মঞ্চেও।
চলচ্চিত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ছাড়াও ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ন অব দ্য অনার’ পদকে ভূষিত হয়েছেন এই অভিনেতা। ২০০৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার। ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) সমর্থক ছিলেন, তিনি ছিলেন বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচকদের একজন।
দুর্গাপূজার সময় তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সিপিএমের মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় তার শেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে সৌমিত্র লেখেন, বামপন্থীদের নিয়ে সংশয় থাকলেও এখনও বামপন্থাকেই বিকল্প হিসেবে দেখেন তিনি। সিপিআইএমের নেতা, ভারতের ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো জ্যোতি বসুর সঙ্গেও সখ্য ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের; ছেলেবেলায় কাকার হাত ধরে জ্যোতি বসুর বিভিন্ন সভায় হাজির হওয়ার স্মৃতি বিভিন্ন লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িয়ে আছেন। তাদের ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায় একজন কবি; আর মেয়ে পৌলমী বসুর ছেলে রণদীপ বসু টালিগঞ্জের উদীয়মান অভিনেতাদের একজন।