ড. কাজী এরতেজা হাসান
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎই গজিয়ে ওঠা একটি সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। যদিও তারা নিজেদেরকে অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সময়ের কর্মকা- রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সেই দলটি এখন ভাঙনের মুখে। গত কয়েকদিন ধরে এই প্রশ্নটি দেশবাসীর সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম কী ভেঙে যাচ্ছে? নানা ঘটনাপ্রবাহ এ প্রশ্নের জš§ দিয়েছে।
হেফাজতকে বগলদাবা করার জন্য নানা মহল উঠে পড়ে লেগেছে, তা, নানা ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হেফাজতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে রাজনৈতিক কুটচালও শুরু হয়েছে। দেশের বৃহৎ এই মুসলিম সংগঠনটিকে কব্জায় নিতে পারলে রাজনৈতিকভাবেও ফায়দা লুটা যাবে; এমন বিশ্বাস থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৌড়ঝাপ লক্ষ্য করার যাচ্ছে। হেফাজতকে যারা কুক্ষিগত করার স্বপ্ন দেখেছে তারা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু তাদের জন্য আশির্বাদ বয়ে নিয়ে আসে। বলা যেতে পারে কারো সর্বনাশ আর কারো পৌষ মাস। আল্লামা শফীর মৃত্যু জামায়াতের জন্য আশির্বাদ বা পৌষ মাস। জামায়াত অনেক আগে থেকেই নিজেদের মতো করে হেফাজতকে চালিত করার পরিকল্পনা আটে। এতে কখনো জামায়াত সফল হয়েছে, কখনো ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াত, হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে এটা দলটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং জামায়াতের মুঠোয় হেফাজতে ইসলাম থাকা মানে, তা বিএনপির জন্য বিশাল রাজনৈতিক সুযোগ। যা বাস্তবায়নের জন্য পর্দার অন্তরালে চলছে নানা চমকপ্রদ ঘটনা।
গত শনিবার ছিল হেফাজতের কাউন্সিল শেষে কমিটি ঘটনা। এই কমিটি গঠন নিয়ে অশুভ ইংগিত মিলছিল। তারই চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেল জুনায়েদ বাবুনগরীকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করা। আল্লামা শফির জীবদ্দশায় হেফাজত কোন ভাবেই জামায়াতের কাছে আত্মসমর্পন করেনি। কিন্তু প্রচার আছে জুনায়েদ বাবুনগরী নিজে এই পক্ষের এক সমঝদার। জামায়াত-বিএনপিপন্থি লোকজন গতকালের কমিটিতে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে বলে গতকালের খবর থেকে জানা গেছে। এটি যে ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে ক-দিন ধরে হেফাজতের অনেক বিজ্ঞ আলেম হুঁশিয়ার করে এসেছেন। দ্বীনি আলেমদের মতে এটি মহাবিপদের সঙ্কেত। ইসলাম এবং জাতির জন্য যা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক জামায়াত, উঠে পড়ে লেগেছে, হেফাজতে ইসলামকে কব্জায় নিতে। জামায়াতকে সরাসরি উৎসাহ যোগাচ্ছে বিএনপি। শাহ আহমদ শফী মৃত্যুর পর হেফাজতকে নিজেদের কব্জায় নেওয়ার অপেক্ষায় ছিল জামায়াত-বিএনপি। সুর্বণ সুযোগ নক রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে এটি ঘটা কোন অসম্ভব কিছু নয়। তাদের সেই শঙ্কায় বাস্তবে দৃশ্যমান হলো।
হেফাজতের শাহ আহমদ শফীপন্থি বিজ্ঞ ব্যক্তিরা গত শনিবার গঠিত হেফাজতের কমিটিতে বাদ পড়েছেন এবং তারা গণমাধ্যমকে জোরের সঙ্গে বলেছেন, বাবু নগরীদের কমিটি ‘অবৈধ’। শফীপন্থিদের এই দাবির পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কারণ বাবুনগরী মনে প্রাণে জামায়াত-বিএনপি ঘেষা লোক। জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনি সবসময় ব্যকুল থাকেন। হেফাজতে ইসলামকে কিভাবে জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক ফায়দা এনে দেওয়া যায়, এটা তার সারাক্ষণ ধ্যান-জ্ঞান। অনেকে জানেন, এই বাবুনগরী কট্টোর পাকিস্তানপন্থি। রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে একবার হেফাজতের যে সমাবেশ হয়েছিল, তার পেছনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বাবুনগরী। আমির আহমদ শফীর মৃত্যু হওয়ায় তিনি শুরু থেকে শফীর স্থান করায়ত্ত করার লক্ষ্যে মাঠে নামেন। এতে বাবুনগরী সফল হয়েছেন এবং কমিটিতে আহমদ শফীর ছেলেকে পযর্ন্ত স্থান দেওয়া হয়নি।
শফী পন্থিরা হেফাজতকে জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে দিতে রাজি নন। তারা হেফাজতে রাজনৈতিক চেহারা দিতে রাজি নন। তারা দলটিকে ইসলামের প্রকৃত সেবক হিসেবে জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরতে চায়। দেশ বিরোধী কোনো কর্মকা-ে হেফাজত, জামায়াতের ইন্দনে জড়িয়ে পুড়–ক এটা তারা মোটেই প্রত্যাশা করেন না। এ কারণেই বাবুনগরী তীক্ষè কৌশল অবলম্বন করে শফীপন্থিদের হেফাজতের নবগঠিত কমিটি থেকে বাদ দিয়েছেন। গতকাল গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিল শেষে যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তা ‘অবৈধ’ বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা। তবে এখনই পাল্টা কোনো কমিটির দিকে তারা যাচ্ছেন না। তারা বলেছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের আমির পদটি শূন্য হয়। সেজন্য গতকাল রবিবার হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদরাসায় সম্মেলন ডাকা হলেও তাতে আমন্ত্রণ পাননি শফী সমর্থকদের অনেকে। কাউন্সিল শেষে নতুন কমিটিতে আমির হিসেবে জুনাইদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব হিসেবে নূর হোসেইন কাসেমীর নাম ঘোষণা করা হয়। হেফাজতের কর্তৃত্ব বাবুনগরীর হাতে আহমদ শফী যখন আমির ছিলেন, তখন তার ছাত্র জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন মহাসচিব আর ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক নূর হোসাইন কাসেমী ছিলেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির। সেই কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী এবং আহমদ শফীর ছেলে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানি গতকাল ঘোষিত কমিটিতে কোনো পদ পাননি।
এই বছরের মাঝামাঝিতে শফীর ছেলে আনাস মাদানির সঙ্গে দ্বন্দ্বে মাদরাসার পদ হারান বাবুনগরী, তবে হেফাজতের মহাসচিবের পদে থেকে যান। ওই ঘটনার জের ধরে এক দল মাদরাসা শিক্ষার্থীর বিক্ষোভের মুখে মাদরাসার মহাপরিচালকের পদ ছাড়েন আহমদ শফী; তার ছেলে আনাস মাদানিকেও বরখাস্ত করা হয়। এরপর বাবুনগরী আবার মাদরাসার পদে ফেরেন। হাটহাজারী মাদরাসার কর্তৃত্ব হারানোর পরদিনই আহমদ শফী মারা যান। এরফলে আমিরের শূন্যপদ পূরণে বাবুনগরীরা সক্রিয় হয়ে ওঠার পর থেকে তার বিরোধিতা করছেন শফীর অনুসারীরা। গতকাল সম্মেলনে জুনাইদ বাবুনগরীসহ হেফাজত নেতারা রোববারের সম্মেলনে জুনাইদ বাবুনগরীসহ হেফাজত নেতারা গতকাল নতুন কমিঠি ঘোষণার পর মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘এই কমিটি অবৈধ। আমরা এটা প্রত্যাখ্যান করি। ‘এই কাউন্সিলের যিনি আহ্বায়ক, সেই মহিবুল¬াহ বাবুনগরীর হেফাজতে ইসলামে সদস্য পদও নেই। এরকম একজন ব্যক্তি কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করতে পারেন না।’ মঈনুদ্দীন রুহীর দাবি, গত শনিবার হাটহাজারী মাদরাসায় হওয়া কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে থাকা ৬৫ জনই উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমি এখন ঢাকায় আছি। সিনিয়র নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেছি। যেহেতু গঠনতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিল বা সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই এর সবই অবৈধ।’ নিজেদের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব। সময়ই বলবে আমরা কী করব। সেই সিদ্ধান্ত আপনাদের জানাব।’ হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বাবুনগরীর এই খেলা তাতে হেফাজতে ভাঙনের কবলে পড়তে বাধ্য বলে রাজনৈতিক বিশে¬ষকরা মনে করছেন। হেফাজতে ইসলামকে সরকারের বিরুদ্ধে চালিত করার যে খায়েশ নিয়ে বাবুনগরী হেফাজতের কমিটির আমির হয়েছেন; তাতে তিনি মোটেই সফল হতে পারবেন না। তিনি কিছুদিনের জন্য হয়তো নির্বাচিত আমিরের পদে থাকতে পারবেন, কিন্তু এটি কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, বাবুনগরী যে কুটচালে হেফাজতে ইসলামকে সরকারের বিরুদ্ধে চালিত করার জন্য শফীপন্থিদের কমিটি থেকে বাদ দিয়েছেন, এটা তার নির্বুদ্ধিতারই প্রমাণ বলে আমরা মনে করি। তবে আমরা বলতে চাই, হেফাজতকে রাজনৈতিক রুপে নয় ইসলামের সেবক দলে পরিণত করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।