আজ সেই দুঃসহ স্মৃতির ভয়াল সিডরের দিন। উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় সিডর। এদিন উপকূলের প্রকৃতি ও মানবতাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সুপার সাইক্লোন সিডর। দিনটি উপকূলবাসীর জন্য বেদনার।
সরকারি হিসাব অনুযায়ি, সেদিন শুধু বরগুনা জেলাতেই এক হাজার ৩৪৫ জন মানুষ প্রাণ হারায়। নিখোঁজ ১৫৬ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এবং আহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০ জন। মাত্র আধাঘণ্টার তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূল। প্রবল তোড়ে বেড়িবাঁধ উপচে এবং ভেঙে পানি ঢুকে চেনা জনপদ মুহূর্ত্যে পরিণত হয় ধ্বংসন্তুপে।
বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়নের গর্জনবুনিয়া গ্রামের আব্দুস ছাত্তার এবং আছিয়া বেগম সেই রাতে কয়েকজন স্বজন হারান। সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই রাতে ৭ জন স্বজন হারিয়েছিলাম আমরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রচন্ড বাতাসের সঙ্গে যুক্ত হয় জলোচ্ছ্বাস। রাত ১০টার পরই সিডর আঘাত হানে। প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আব্দুস ছাত্তারের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ চারজনকে। অন্যদিকে আছিয়া বেগম তিনজন স্বজনকে হারিয়েছেন সেই রাতে।
বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নলটোনা। এই এলাকায় সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিল না। ফলে সিডরের সময় এই জায়গায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল ২০ ফুটের মতো। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিনই সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে ডুবেছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনও স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ২৯ জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়। জায়গার অভাবে ৪টি কবরে ৩ জন করে ১২ জন, ৩টি কবরে ২ জন করে ৬ জন ও ১২টি কবরে ১ জন করে ১২ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে।
বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছিল। বর্তমান জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় সেখানে সিডর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে এখনও সেখানে থমকে দাঁড়ায়। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে এসব কবর।
কবরগুলোতে শুয়ে আছেন, নলটোনা গ্রামের তাসলিমার বাবা আবদুর রশিদ (৫৫), মা আম্বিয়া খাতুন (৫০), ছেলে আল আমিন (৭), ফোরকানের বাবা দিন আলী (৬৫), হাসি বেগমের মেয়ে শাহিনুর (৪), শাহজাহানের মা তারাভানু (৬০), মেয়ে খাদিজা আক্তার (৩), আনিসের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩০), ছেলে আবু বকর (৩), রফেজ উদ্দিনের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩৫), মাসুমের মা হেলেনা আক্তার (৩০), বাদলের মা লালবরু (৬৭), বাবুলের মেয়ে জাকিয়া আক্তার (৮), আবদুস সত্তারের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন (৩০), ছেলে রেজাউল (১২), রেজবুল (৭), মেয়ে সাবিনা (৯), সগির হোসেনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (৩), আবদুর রবের ছেলে হোসেন আলী (১২), মেয়ে ময়না (৭), হোসনেয়ারা (৫), শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম (৫০), সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার (৩০), মেয়ে রোজিনা (৪), ছত্তারের স্ত্রী বেগম (৫০), পুত্রবধু নাজমা আক্তার (৩০), নাতি পারভেজ (৪), নাসির উদ্দিনের স্ত্রী হোসনেয়ারা (২৬) ও গর্জনবুনিয়া গ্রামের গনি বিশ্বাসের ছেলে জাহিদ হোসেন (৫)।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সিডর বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। যা কেড়ে নিয়েছে উপকূলবাসীর সাহায় সম্বল, কেড়ে নিয়েছে আপনজনদের। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তবু সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করলে উপকূলবাসী কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। সেই সঙ্গে পরবর্তী ভয়াবহতার হাত থেকেও রক্ষা পাবে।