#মুখোমুখি আওয়ামী লীগ-বিএনপি
#২০১৪-১৫ সালের দুর্বিসহ আগুন সন্ত্রাসের ভয়াল স্মৃতি তাড়া করছে মানুষকে
প্রকাশ: শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০, ১২:৪৩ পিএম আপডেট: ১৪.১১.২০২০ ১:০৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৪-১৫ সালে সংঘটিত বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ সহিংসতার স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় বাংলাদেশের মানুষকে। রাজপথ থেকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সর্বত্র মানুষের আর্তচিৎকার, পোড়া মানুষের বিভৎস চেহারাগুলো এখনো ভেসে ওঠে মানুষের চোখের সামনে। বিশেষ করে ১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিএনপি-জামায়াতের টানা অবরোধ কর্মসূচির প্রতিদিনই জ্বলেছে বাংলাদেশ। আর আতঙ্কিত বনপোড়া হরিণীর মতো এক চিলতে শান্তির আশ্রয় খুঁজেছে দেশের মানুষ। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠে দেশ নানামাত্রিক উন্নয়নের দিকে হাঁটছে। বিরাজ করছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু তার মধ্যেই হঠাৎ যেন ছন্দপতন ঘটলো। গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকায় কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুড়লো ১০টি বাস। ঢাকার অন্তত ৮টি পয়েন্টে বাসে আগুন দিয়ে, বিভিন্ন স্থানে বোমা ফাটিয়ে ফের ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ খবর চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। আবার সেই ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে দেশ ফিরে যাচ্ছে কি-না এমন শঙ্কায় ভরে ওঠেছে মানুষের মন। বৃহস্পতিবার শাহবাগে বাসে আগুন জ্বলতে দেখে ফাতেমা আকতার নামের এক নারী আঁৎকে উঠেছেন। ভোরের পাতাকে তিনি বলেছেন, ‘১৪ সালের সেই দুর্বিসহ সময়ের কথা ভুলিনি। বাসে ওঠে চাকরিতে যেতে পারতাম না। সব সময় ভয় থাকতো কখন কে কোথায় আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো।’
প্রেসক্লাব এলাকায় বাসে আগুন দেখে একই অনুভূতি কাজ করছিল তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে উপনির্বাচন চলছিল। একই দিন বিএনপি অফিসের সামনে বিশাল জমায়েত দেখা গেছে। যুবদলের মিছিল হয়েছে। এ অবস্থায় প্রেসক্লাব, পল্টন, শাহবাগে বাসে আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাধারন মানুষের মধ্যে মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেককেই কাজ শেষ করে ছুটোছুটি করে দ্রুত বাসায় ফিরতে দেখেছি। আমার নিজেরও মনে হচ্ছিল, আবার সেই ২০১৪-১৫ সালের অবস্থা ফিরে আসছে কি না।’
গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজারের কাছেই একটা বাসে আগুন জ্বলতে দেখেছে ভবঘুরে আব্দুল মজিদ। তার ভাষায় তিনি বলছিলেন, ‘বাসের পেছন থেইকা কেডায় জানি আগুন লাগায়া ফুটছে। দাউ দাউ কইরা জ্বলতেছিল বাসটা। মানুষ হুড়হুড় কইরা পালায়া বাঁচছে।’ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘চাইর পাঁচ বছর আগেও এমন দেখছিলাম। কত মানুষ মরছে। একবার একটা পুইড়া কালো হয়ে যাওয়া বাচ্চারে বইসা থাকতে দেখছিলাম আমি। পাশেই কেডা জানি কাঁদতেছিল’।
২০১৪ সালের বিএনপি-জামায়াতের টানা আন্দোলন, খালেদা জিয়া ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি দেশকে ফেলে দিয়েছিল এক নৃশংস পরিস্থিতিতে। আগুনসন্ত্রাস, পেট্রলবোমায় টানা ৯২দিন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় ৩ মাসের অব্যাহত আগুন ও পেট্রলবোমায় প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় দেড়শো জন। প্রাণ হারানো অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন খেটে খাওয়া, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ফলে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলকে সেই আত্মঘাতি রাজনীতির খেসারত দিতে হচ্ছে এখনো।
যদিও বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরপরই বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এসব ঘটনায় বিএনপি জড়িত নয়। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, এটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আমি তীব্রভাষায় এর নিন্দা করছি। আমরা যারা রাজনীতি করি তারা সবসময় শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করি। এগুলো কখন হয় যখন দেশে কোনো গণতান্ত্রিক স্পেস থাকে না। স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, বিএনপি এই রাজনীতি করে না।’ সরকারের বিভিন্ন এজেন্ট এসব কা- ঘটায় বলেও দাবি করেন তিনি।
অপরদিকে সরকারপক্ষের লোকজন দুষছেন বিএনপিকেই। বলছেন জামায়াতের সঙ্গে মিলে সহিংসতার ইতিহাস আছে দলটির। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেও বলেন, ‘সেই পুরানো আগুন সন্ত্রাসের সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি, এটা তারা আগের মত শুরু করেছেন। এর মধ্যে একটি ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে, পুলিশের কাছে আছে, এখানে বিএনপি কর্মীদের উপস্থিতি চেহারা দেখলে বোঝা যায়। কৌশলটা ছিল এমন যে, বাসের ভেতরে যাত্রী সেজে বসে থেকে আগুন লাগানোর সময় আগুন আগুন বলে যাত্রী সেজে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।’
দুই বড় দলের দুই নেতার এমন মুখোমুখি অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আবারো উত্তাপের আভাস দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে উপনির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ‘মিথ্যা মামলায়’ গ্রেফতারের প্রতিবাদে দুই দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আজ শনিবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এবং রোববার কাল সারা দেশে জেলা সদরে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। সংবাদ সম্মেলন থেকেই এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মির্জা ফখরুল।
আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে ও আশে পাশের এলাকায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল। এরপর থেকে গত দুই বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল কার্যত শান্ত।
এদিকে ঢাাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার এবং মুখপাত্র ওয়ালিদ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিটির আলাদা আলাদা মামলা হবে। এখনো পর্যন্ত ঢাকার কয়েকটি থানায় মামলা হয়েছে। তিনি জানান, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েক জনের ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা’ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, সংঘবদ্ধভাবে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এ ধরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সিসি ক্যামরার ফুটেজ সংগ্রহ করে বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।