মাছে ভাতে বাঙালির মাছ ছাড়া ভোজ যেন অসম্পূর্ণ। আসলে নদীমাতৃক আর কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় বাঙালির পরিচিতি হয়েছে মাছে ভাতে বাঙালিতে। দেশে অনেক খাল, বিল, নদী থাকায় এদেশের মৎস্যখাত বেশ সমৃদ্ধ। তবে এসব দেশীয় মাছের পাশাপাশি বিদেশি এবং সামুদ্রিক মাছও আমাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রসনা বিলাস দুই-ই পূরণ করে মাছ। বর্তমানে আমাদের দেশে বছরে মাছের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪২ লাখ টন। দেশীয় মাছের পাশাপাশি বর্তমানে দেশের মাছের চাহিদা পূরণ করছে বিদেশি মাছগুলোও। জনপ্রিয় কয়েকটি মাছের ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব হওয়ায় এই চাহিদা পূরণের পর প্রতিবছর কিছুটা উদ্বৃত্তও থাকে।
গবেষকরা বলছেন, অন্তত তিনটি মাছই দেশের মাছ উৎপাদনের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। তবে এর মধ্যে দুটি মাছ দেশীয় হলেও এর বিস্তার সম্ভব হয়েছে বিদেশি প্রজাতির কারণে। এখন বাজারে সবচেয়ে সহজলভ্য এই মাছগুলো হলো- কই, পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশি জাতের কই এখন বিপন্ন প্রজাতির মাছ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে কই মাছ থেকে আসে ৫৩ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন। তবে এর মধ্যে দেশি জাতের কই মাছের পরিমাণ কত তার হিসাব পাওয়া কঠিন।
মৎস্য গবেষক ও খামারিদের মতে, ৯০ এর দশক থেকেই দেশি জাতের বিভিন্ন জাতের মধ্যে কই মাছও ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। পরে ২০০৩ সালে থাই কই মাছের চাষ শুরু হয়। কয়েক বছর পর ২০১১ সালে ভিয়েতনামের কই মাছ চাষ শুরু হয়। থাই কই মাছের দৈহিক বৃদ্ধি দেশি কই মাছের দ্বিগুণ, উৎপাদন খরচও কম।
আবার হেক্টর প্রতি ভিয়েতনামের কই মাছ পাওয়া যায় ১৫ মেট্রিক টন। এসব কারণেই খামারিরা দেশি ও থাইল্যান্ডের কই মাছ বাদ দিয়ে ভিয়েতনামের কইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
আবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পাঙ্গাসের উৎপাদন ছিল চার লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৩ টন। যার বাজার মূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বাজারে এখন সবচেয়ে সহজলভ্য মাছগুলোর একটি হলো পাঙ্গাস। যা চাষের পাঙ্গাস হিসেবেই পরিচিত।
তবে এখনো দেশীয় নদী কিংবা প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া পাঙ্গাস অনেক দামেই বিক্রি হয়। আর স্বাদেও এগুলো চাষের পাঙ্গাসের তুলনায় অনেক বেশি ভালো। এখন থাই পাঙ্গাসের কারণে মাছটি হারানোর হাত থেকে রক্ষাই পায়নি বরং গণমানুষের কাছে সহজলভ্য হয়েছে।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরে ১৯৯০ সালে কৃত্রিম প্রজননে সর্বপ্রথম থাই বা সূচী পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদন ও পরবর্তীতে পুকুরে চাষ শুরু হয়। এরপর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পাঙ্গাস চাষ প্রযুক্তি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের আমিষ প্রাণীজ চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে এই মাছ। মূলত পাঙ্গাসের ক্ষেত্রে দেশি জাতের পাঙ্গাস ও থাই পাঙ্গাসই বিশেষভাবে জনপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বলেন, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই খামারিরা কই ও পাঙ্গাসের বিদেশি প্রজাতির দিকে ঝুঁকেছেন। যদিও তেলাপিয়া বিদেশি প্রজাতি নয় বরং জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড করা হয়েছে। তবে তেলাপিয়া বাংলাদেশের নিজস্ব মাছ নয় বলেই বলছেন তিনি।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রণীত বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৯৫৪ সালে তেলাপিয়া বাংলাদেশে এসেছিলো প্রথম বিদেশি মাছ হিসেবে। আবার ইউনিসেফ ও মৎস্য অধিদপ্তর যৌথ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে আরেক জাতের তেলাপিয়া নিয়ে আসে।
এছাড়া মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট থাইল্যান্ড থেকে আরো কিছু তেলাপিয়া আমদানি করেছিল ১৯৮৭ সালে। এর বাইরে ফিলিপাইন থেকে ১৯৯৪ সালে খামারে জন্মানো বংশগতভাবে উন্নত তেলাপিয়া বাংলাদেশে আনা হয়।
মালিহা হোসেনের মতে, আগের মতো পুকুর, খাল, বিল কিংবা জলাশয় নেই। তাই দিন দিন এই মাছগুলো আরো কমছে। তাই কইয়ের মতো দেশি মাছ কমে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রথমে থাই ও পরে ভিয়েতনাম থেকে আসা কই থেকে খামারিরা ব্যাপক সফল হয়েছে। মাছের বাজারে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
মূলত থাই প্রজাতির কইয়ের চেয়ে বেশি বর্ধনশীল বলা হয় ভিয়েতনামের কই মাছকে। পুকুরে চার মাসের মতো সময় চাষ করে গড়ে প্রতিটি মাছ প্রায় ২৫০ গ্রাম আকার ধারণ করে। যা থাই কিংবা দেশি জাতের কই এর তুলনায় অনেক বেশি।
মাছ গবেষকরা বলছেন, বিদেশি প্রজাতির মাছ এসে যেমন উৎপাদন চিত্র পাল্টে দিয়েছে, তেমনি বিলুপ্তির পথে থাকা বেশ কিছু মাছকেও গবেষণার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সক্ষম হয়েছে। ফলে টেংরা ও পাবদাসহ বেশ কিছু বিলুপ্তির পথে থাকা মাছ আবার ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে।
যদিও বাজারে তার দাম অনেক বেশি। চেষ্টা করা হচ্ছে দেশি জাতের কই কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়েও। তবে অনেক গবেষক আবার মনে করেন, বিদেশি প্রজাতির মাছের কারণেই কমে যাচ্ছে দেশীয় জাতের মাছ।
সূত্র: বিবিসি