প্রকাশ: শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২০, ৩:১৫ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
মা সাবিহা নাসরিন একজন কারুশিল্পী। একসময় নারীদের সাবলম্বী করতে হস্তশিল্পের কাজ শেখাতেন বিনামূল্যে। চারুকলার প্রতি নিবিড় অনুরাগ থেকে সন্তান তরিক হাসনাতকে পড়িয়েছেন চারুকলায়। তারিক ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা অনুষদের স্নাতক ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। শিল্প বিষয়টি এত গাঢ় অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো মা সাবিহা নিজের সবটুকু ব্যয় করেছেন সন্তান তরিকের শিল্প-শিক্ষার পেছনে। সেই মা যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন তখন সন্তানও তার সর্বস্ব নিয়ে মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এটিই তো হওয়ার কথা ছিল। সন্তান কি মায়ের এক বিন্দু চলৎহীনতা সহ্য করতে পারে? কিন্তু একজন চিত্রশিল্পী সন্তানের সর্বস্ব বলতে কি আর থাকে? মায়ের দৌলতে যা পেয়েছেন, সেই শিল্পই একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়ালো তরিকের কাছে। মায়ের চিকিৎসার জন্য ভিক্ষার হাত পেতে বসেননি তিনি। নিজের চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজন করেছেন উন্মুক্ত প্রদর্শনীর। আর সে প্রদর্শনীতে চিত্রকর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রায় ৩০জন চিত্রশিল্পী। সবাই মিলে প্রদর্শনীর নাম দিয়েছেÑ‘মায়ের জীবন বাঁচাতে উন্মুক্ত চিত্র প্রদর্শনী’। অসুস্থ মা কি কেবলই তরিকের হয়, সেই মা তো সকলেরই। তাই বন্ধু সোহানা তাসনিম, আসাদুজ্জামান সরকার, ইশতিয়াক আহমেদ ফয়সাল, মোরসালিনা অনিকাসহ আরো অনেকে মিলে তরিকের সঙ্গে গত ৬ নভেম্বর থকে ধানমন্ডি ১২/এ লেকের তাকওয়া মসজিদের পাশেই সাজিয়ে বসেছেন চিত্রকর্মেও এক দারুণ পশরা।
প্রদর্শনীর আয়োজকদের একজন, মোরসালিনা অনিকা ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন, হাসনাতের মা গত ২৩ অক্টোবর থেকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন আজ ২০ দিন হয়ে গেল। অক্সিজেন লেভেল ৫৫ নিয়ে তিনি মিরপুর-১০ এর আল হেলাল হাসপাতালে ভর্তি হন ২৩ অক্টোবর। পেশেন্টের কন্ডিশন দেখে সাথে সাথে সিসিইউতে এডমিট করা হয়, তার ঘণ্টাখানেক পর দেওয়া হয় ভেন্টিলেশন অর্থাৎ লাইফ সাপোর্ট, কারণ মারাত্মক অক্সিজেন স্বল্পতায় তার ব্রেন ক্রমশ ড্যামেজের দিকে যাচ্ছিল। তারও কিছু পরে এক্স-রে রিপোর্ট এলে দেখা যায় সিভিয়ার নিওমোনিয়ার কারণে ফুসফুসের মাত্র ৩০% কাজ করছে পেশেন্টের। পরদিন শনিবার রাতে কোভিড-১৯ টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসায় পেশেন্টকে দ্রুত শিফট করার জন্য চাপ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সাথে ধরিয়ে দেয় প্রায় লাখ টাকার বিল। নানান দেনদরবার করে কোন ক্রমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর নিশ্চয়তা পেয়ে অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয় ঢামেক এর দিকে। সেদিনরাত দেড়টায় ঢামেক পৌঁছে জানা যায় আইসিইউতে সিট খালি নেই পেশেন্টকে তারা বড়জোর ওয়ার্ডে রাখতে পারবে। লাইফ সাপোর্ট বা আইসিইউ সুবিধা ছাড়া এ ধরনের রোগীকে বড় জোর ২-৩ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখা যায়। এমনকি উনাকে যে অ্যাম্বুলেন্স বহন করছিল সেখানেও লাইফ সাপোর্ট দিয়েই বহন করা হচ্ছিল। প্রায় এক ঘণ্টার ছুটাছুটি শেষে পেশেন্টের কন্ডিশনের আরও অবনতি ঘটে। শেষমেশ ঢামেক থেকে বাধ্য হয়ে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের কোভিড স্পেশালাইজড সেকশনে এডমিট করানো হয় তাকে। ততক্ষণে অনেক সময় চলে গেছে। পরদিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর জানা যায় সেপটিক শকে রোগীর একটা মেজর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, বিপি আউট অব কন্ট্রোল, সুগার মাত্রাধিক হাই, কিডনি ড্যামেজের দিকে যাচ্ছে আর ফুসফুসে জমেছে পানি।
অনিকা বলেন, তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত সেখানেই আছেন তিনি। হাসপাতালের প্রতিদিনের বিল ৭০-৮০ হাজার টাকা। এ বিল অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিশোধ করার সামর্থ্য কোন মধ্যবিত্ত পরিবারেরই থাকার কথা নয়। এদিকে হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন আশা আছে, কিন্তু রিকভারির জন্য পেশেন্টকে সময় দিতে হবে। অথচ এই মুহূর্তে এ অনির্দিষ্ট সময়ের দাম দেবার সামর্থ্য পরিবারটির নেই। ইতোমধ্যেই দুই হাসপাতাল মিলে বিল হয়েছে ১৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে অধিকাংশ টাকাই শোধ হয়েছে। এখনো বাকি প্রায় ৪ লাখ টাকা। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, আনুমানিক ন্যূনপক্ষে আরও দেড় থেকে দুই সপ্তাহ (১০-১৪দিন) হাসপাতালে থাকতে হবে সাবিহা নাসরিনকে। অর্থাৎ এই সময় পর্যন্ত প্রতিদিনের বিল পরিশোধ করতে হবে। এই দুঃসময়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিপন্ন সন্তান-যিনি একজন শিল্পী তার সম্বল বলতে আছে কেবল তার চিত্রকর্মগুলোই। তা বিক্রি করেই তিনি মাকে বাঁচাতে চাইছেন।
অনিকা বলেন, বন্ধুর মা তো আমাদেরও মা। বন্ধুর দুঃসময় মানে তো আমাদেরও দুঃসময়। তাই আমরা সব চিত্রশিল্পী বন্ধুরা নিজেদের চিত্রকর্ম নিয়ে তরিকের প্রদর্শনীতে এসেছি। এসব চিত্রকর্ম বিক্রি করেই মায়ের চিকিৎসা খরচ বহন করব। ইতোমধ্যেই অনেকে সাড়া দিয়েছেন। প্রদর্শনী দেখতে আসছেন প্রচুর মানুষ। ছবিও কিনছেন তারা। মায়ের জন্য শুভকামনা করছেন। এত মানুষের শুভ কামনা নিশ্চয় বৃথা যাবে না। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন আমাদের মা।
আয়োজকরা আশা প্রকাশ করেছেন, শিল্পকর্ম কিনে একজন মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে নিশ্চয় এগিয়ে আসবেন শিল্পানুরাগী মানুষ। যারা করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রদর্শনীতে আসতে পারছেন না তারা তরিক হাসনাতের সঙ্গে ০১৬৭৬৩২৪১২৮ নম্বরে যোগাযোগ করে ছবি কিনতে পারবেন। অথবা পারসোনাল বিকাশ নম্বর- ০১৬৮৮৭৯৬৮৮৩ অথবা ০১৬২৮৫৮৬২৩১-তে অর্থ পাঠিয়ে ঠিকানা জানিয়ে দিলেই পৌঁছে যাবে চিত্রকর্ম।