ড. কাজী এরতেজা হাসান
ঘুষ, দুর্নীতি-অনিয়ম দেশের জন্য ক্যানসার সমতুল্য। এই ত্রয়ী শত্রুর বিরুদ্ধে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন এবং তা প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার পক্ষপাতি নন তিনি। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের যে প্রধান শত্রু তাকে ছাড় দিলে সর্বনাশ। কেবল সর্বনাশই নয় তা হবে মহাসর্বনাশ। দেশের যে বর্তমান উন্নয়ন-অগ্রগতি, তা আরও অনেক আগেই সম্ভব হতো যদি না দুর্নীতির রমরমা কারবার না চলতো। এই অপকর্মের শুরু কিন্তু অনেক আগ থেকেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দুর্নীতির পত্তন ঘটানো হয় এই দেশে। আমরা যে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ দেখছি, তা দেশের ঘাড়ে তখনই চেপে বসে যখন অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের মহরৎ শুরু হয়।
অবৈধ একজন সেনাশাসক যখন ক্ষমতা গ্রহণের পর বলে বসে, ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ তখনই সংকটের শুরু বলা যেতে পারে। তার এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সমাজের দুর্নীতিবাজরা আশকারা পেয়ে যান। এই সেনাশাসকের ছেলে হাওয়া ভবন বানিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেন। সেনাশাসকের পতœী প্রধানমন্ত্রী থাকলেও ছেলেকে আশকারা দিতে মুক্ত করে দেন দুর্নীতির সব রাস্তা পথ। দুর্নীতির এই বরপুত্র বর্তমানে আদালতের দ- নিয়ে লন্ডনে বসে নতুন করে দুর্নীতি করার খোয়াব দেখছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে যখন দুর্নীতি হয়, তখন তার শিকড় নিচেই নামবে এটাই স্বাভাবিক। তাই সময় নেয়নি দুর্নীতির বিষবৃক্ষ মহীরুহ হতে। ফলে দেশে যে অনিয়ম-দুর্নীতি, একে নিমিষে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতি বাঙালি জাতিকে এই অভিশাপ থেকে দ্রুতই মুক্ত করবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান এই লড়াই দুর্নীতি শেষ করেই থামবে বলে আমরা বিশ^াস করি। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক যে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাতে দুর্নীতিবাজদের একটি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে অবস্থাদৃষ্টে প্রমাণ হচ্ছে, সরকার নিজের দলের দুর্নীতিবাজদেরও ছাড় দিতে রাজি নয়। দলের দুর্নীতিবাজদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে দলের ভাবমূর্তির গায়ে আঁচড় লাগাটাকেও দলের বৃহৎ অংশ মেনে নিতে রাজি নয়। দলের ভেতর থেকেই দুর্নীতিবাজদের রেহাই না দেওয়ার প্রবল দাবি থাকে এবং সেই দাবির প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির ইতোমধ্যে দেখা গেছে। গতকাল গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বর্তমান এবং সাবেক ২২ এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মধ্যে ১১ জন বর্তমানের সাংসদ এবং বাকিরা সাবেক। এদিকে, অর্থপাচারের অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের এমপি মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম পাপুল, তার সাংসদ স্ত্রীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা পাচার ও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান ও সাবেক এসব এমপির বিরুদ্ধে অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। টিআর, কাবিখাসহ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আছে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগও। দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বর্তমান সংসদের অভিযুক্ত ১১ এমপি হলেন চট্টগ্রাম-১২ আসনের শামসুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, বরিশাল-৪ আসনের পঙ্কজ দেবনাথ, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরী, সন্দ্বীপের মাহফুজুর রহমান মিতা, ভোলার আবদুল¬াহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের আফজাল হোসেন, শেরপুরের আতিউর রহমান আতিক ও বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরী। অভিযুক্ত সাবেক এমপিরা হলেন- আওয়ামী লীগের এ কে এম এ আউয়াল (পিরোজপুর-১), বি এম মোজাম্মেল হক, কামরুল আশরাফ খান পোটন, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, শামসুল হক ভূঁঁইয়া, বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল মোমিন তালুকদার, শহিদুজ্জামান বেল্টু ও জাতীয় পার্টির এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। বর্তমান ও সাবেক ২২ এমপির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান প্রমাণ করে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বিষয়ে কোন ছাড় দিতে রাজী নন। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশবাসীও আনন্দিত। দেশবাসী চায়, শূন্য অবস্থানে নেমে আসুক অনিয়ম-দুর্নীতি-ঘুষ। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো- অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষকে তিরোহিত করা। সরকারি-বেসরকারি কেউ যেন দুর্নীতি করতে না পারে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা জানি, বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দেশের কাঙ্খিত উন্নতি সাধনে দুর্নীতিকে ছাড় দেবেন না।
বিশ্বের যেসব উন্নত দেশ, কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছেছে, এতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। ফলে আমাদের প্রশাসনকে কলুষমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি বাসা বেঁধে আছে এবং প্রশাসনের দুর্নীতিবাজরা রাজা-বাদশাদের মতো দর্পে হেঁটে বেড়ায়। দুর্নীতি করে তাদের কোনো অপরাধবোধ নেই। বরং দুর্নীতি করে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে ধরাকে শরাজ্ঞান করাই তাদের প্রবণতা।
আমরা মনে করি প্রতিটি দুর্নীতিবাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। দুদক এ ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর হলে একজন দুর্নীতিবাজ পালিয়ে বাঁচবে না। এই অবস্থানে দুদক থাকলে আমরা আশাবাদী দুর্নীতি দ্রুতই শূন্যে নেমে আসবে। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক গুণ বেড়ে যাবে। দেশের মানুষের জীবন-মান, আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটাবে। ফলে সমাজ-রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের জেলের ভাত খাওয়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দুর্নীতিবাজদের সকল দর্প ভেঙে গুড়িয়ে দিতে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এই জিরোটলারেন্স নীতিকে দেশবাসী সর্বাত্মকরণে সমর্থন করে।