ড. কাজী এরতেজা হাসান
আজ ১০ নবেম্বর, শহীদ নূর হোসেন দিবস। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন-সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একদিন। ১৯৮৭ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান লিখে বিক্ষোভ করেন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় (বর্তমান শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার) পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি।
স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্লোগানটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ স্লোগানটি যিনি বুকে ও পিঠে ধারণ করে তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে (১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর) শহীদ হন তিনি নূর হোসেন। শহীদ নূর হোসেন দিবস আজ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন-সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় দিন। গণতন্ত্র ও শহীদ নূর হোসেন বাংলা মায়ের যমজ সন্তান। একই চেহারায় ভিন্ন দুটি নাম। গণতন্ত্র মানে নূর হোসেন, নূর হোসেন মানে গণতন্ত্র। সেই থেকে ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে। বাংলাদেশের মাটিতে নূর হোসেনের মতো সাহসী মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশই হবে শহীদ নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উৎকৃষ্ট উদ্যোগ । ১৯৮৭ সালের এই দিনে এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনে বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লেখা স্লোগান নিয়ে বিক্ষোভ করেন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় (বর্তমান শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার) পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অকুতোভয় সেই যুবকের অগ্নিঝরা স্লোগান সহ্য হয়নি তৎকালীন শাসকের। লেলিয়ে দেয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। গুলিতে আরো শহীদ হন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটোও। নূর হোসেনের আত্মত্যাগে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারের পতন ঘটে। এরপর থেকে প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
নূর হোসেনের জন্ম বরিশালে ১৯৬১ সালে। জীবিকার সন্ধানে তার গোটা পরিবার এসেছিল ঢাকায়। থাকতেন রাজধানীর পুরনো ঢাকার বনগ্রামে। বাবা মজিবুর রহমান পেশায় বেবিট্যাক্সি চালক। মা মরিয়ম বেগম গৃহিণী। নূর হোসেন নিজেও ছিলেন একজন পরিবহন শ্রমিক। ১৯৮৭ এর ১০ নভেম্বর ছিল ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি। নূর হোসেনের প্রতিবাদী মন সম্পর্কে পরিবারের সবার জানা ছিল। পরিবারের দিক থেকে বারণ ছিল যাতে নূর হোসেন মিছিলে না যান। রাস্তায় অনেক ঝামেলা হতে পারে ভেবেই এই বারণ ছিল।
তবুও নূর হোসেন মিছিলে গেলেন। আগের দিনই ইকরাম নামে এক সাইনবোর্ড লেখকের কাছে গিয়ে নিজের শরীরকে পোস্টারে পরিণত করেছিলেন। লেখার সময়ই নূর হোসেনকে ইকরাম সতর্ক করে বলেছিলেন যে – এ কাজের অর্থ হলো নিশ্চিত কারাগারে যাওয়া। সেই সঙ্গে তাঁর নিজেরও বিপদে পড়া।
প্রথমে না করলেও পরে নাছোড়বান্দা নূর হোসেনের পীড়াপীড়িতে তিনি তার শরীরে স্লোগান লিখে দেন। মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় এক অন্য নূর হোসেন, যে নূর হোসেন অচেনা হয়ে যান শিল্পী ইকরামের কাছে, এমন কি নিজের কাছেও। নয় তারিখ রাতে এই পোস্টার লেখা থেকে পরের দিন ১০ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত সেই স্লোগান ধ্বনিত হতে থাকে নূর হোসেন এর শরীরের কোষে কোষে, ঘুম কিংবা ঘুমহীনতার ঘোর আর স্বপ্নের প্রতিটি অলিন্দে।
পায়ে কেডস। পরনে জিন্সপ্যান্ট। গায়ের শার্ট কোমড়ে বাঁধা। খালি গায়ে বুকে পিঠে লেখা স্বৈরাচার নিপাত এবং গণতন্ত্র মুক্তির স্লোগান। গোটা শরীরটাই যেন একটা ত্রিমাত্রিক পোস্টার। ১০ তারিখ ভোরে শহরের প্রথম আলোয় ঝলসে উঠেন নূর হোসেন। সূর্যের সব আলো প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর বুকে পিঠে। এতটা বোধ হয় স্বৈরাচারের দূষিত আত্মা নিতে পারেনি। তার ভণ্ড স্বৈরসত্তা কোথাও তার প্রেতপূজার দীপ নিভে যাওয়ার আভাস পেয়েছিল। তাই নির্মম বুলেট ছুটে আসে নূর হোসেনের দিকে।
নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। কবি শামসুর রাহমান যেমনটি লিখেছেন তার কবিতায়, “ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়”। মরণ যন্ত্রণায় যখন নূর হোসেন ছটফট করছিলেন তখন এক যুবক তাঁকে একটি রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন। নূর হোসেনকে বহনকারী রিকশাটিকে পুলিশ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয় তারা। তিনি যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, তখন একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তার বুক চেপে ধরে। স্বৈরাচারের পুলিশেরা এতটাই নিষ্ঠুর ছিল।
এরপর মিছিলের সাথীরা কিংবা স্বজনরা নূর হোসেনের খোঁজ আর পায়নি। বিনা চিকিৎসায় যন্ত্রণাময় এক মহৎ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন গণতন্ত্রের এই সাহসী বীর। দুপুরের দিকেই স্বজনরা বিভিন্ন দিক থেকে খবর পান যে নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নূর হোসেন এর বোন শাহানার ভাষ্য মতে, সন্ধ্যায় বিবিসি এর খবর শুনে তারা নিশ্চিত হন যে নূর হোসেন শহীদ হয়েছেন। আরও পরে পত্রিকার খবর থেকে স্বজনরা জানতে পারেন যে জুরাইন কবরস্থানে তার কবর হয়েছে। এ খবর শুনে স্বজনরা ছুটে যান জুরাইনে। কবরস্থানের কর্মীরা বলেন, এখানে তিনজনের নতুন কবর হয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজনের মুখে দাঁড়ি, পায়ে কেডস জুতা, পরনে প্যান্ট, খালি গা এবং বুকে-পিঠে কী যেন লেখা ছিল। এসব বর্ণনা থেকে স্বজনরা আন্দাজ করে নেন কোনটা নূর হোসেনের কবর।
১০ নভেম্বরের আগের দু’দিন নূর হোসেন ঘরে ফেরেননি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার সক্রিয়তা সবসময়ই ছিল। কিন্তু ১০ নভেম্বর নিয়ে পিতা-মাতার মনে ভয় ছিল। তাই নূর হোসেনের কাছে মিছিলে না যাওয়ার অনুরোধ ছিল বাবা মায়ের দিক থেকে।
১০ নভেম্বর ভোরের আলো ভালোভাবে ফুটে উঠার আগেই মা-বাবা ছেলের খোঁজে বের হলেন। হাজির হন মতিঝিলের নির্মাণাধীন ডিআইটি (রাজউক) মসজিদের একটি কক্ষে। সেখানে গিয়ে দেখেন নূর হোসেন খালি গায়ে শুয়ে আছে। সাথে আছে তার এক বন্ধু।
মা-বাবাকে দেখেই তিনি তড়িঘড়ি করে চাদর দিয়ে গা ঢেকে ফেলেন। মা কিন্তু বুকে পিঠের লেখা দেখে ফেলেন। পৃথিবীতে ছেলের জীবন্ত পোস্টার হয়ে যাওয়া দেখেছেন এমন মা বোধ হয় একজনই। তিনি নূর হোসেনের মা। দারিদ্রের কারণে হয়তো ছোটবেলায় ছেলেকে একটা শার্ট সবসময় কিনে দিতে পারেন নি।মায়াবী হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ছেলের উদোম গায়ে। আজ এই বুক-পিঠ পোস্টার হয়ে যাওয়া ছেলের দিকে এক অবাক নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাকান মা। মায়ের ভালবাসার হাত সন্তানের পিঠ ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় পিঠে লেখা শব্দ ‘গণতন্ত্র’কে।
মায়ের মনে এক বুড়িগঙ্গা দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মা বলেন, চল বাসায় চল। নূর হোসেন অতল অটল থাকলেন। বাবা- মাকে বললেন,“আপনারা যান। আমি আসতেছি”। সেটাই ছিল শেষ দেখা। নূর হোসেনকে যখন জুরাইন কবস্থানে দাফন করা হয় তখন কেরোসিন দিয়ে তারা তাঁর শরীর থেকে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” এই স্লোগান তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা তা মুছে ফেলতে পারেনি। নূর হোসেন তাঁর শ্লোগানকে নিয়েই কবরে গেছেন। গণতন্ত্রকে বুকে ধারণ করে যার শেষ যাত্রা, তিনি অমর অক্ষয়। নূর হোসেনের এই আত্মদান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত করেছে। আমাদের জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিরাপদ। আজ শহীদ নূর হোসেনের প্রয়াণ দিবসে আমরা শপথ করতে পারি, দেশের ভিতরে ও বাইরে এখনো যারা এদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, তাদের রুখে দিতে হবে। তাহলেই শহীদ নুর হোসেনের আত্মা শান্তি পাবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক:
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম
পরিচালক, এফবিসিসিআই।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ