নিয়মিত অফিস করেন বহিরাগতরা, টাকা হলেই মিলছে অনভিজ্ঞদের লাইসেন্স-ফিটনেস সার্টিফিকেট, বাড়ছে সড়ক দূর্ঘটনা
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও ময়মনসিংহ সার্কেল কার্যালয়েরচিত্র ভিন্ন। এখানে ঘুষ ছাড়া মেলে না সেবা। টাকা হলেই অনভিজ্ঞরা পাচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স।সড়কের আনফিট গাড়ীগুলো পাচ্ছে ফিটনেস সার্টিফিকেট। আর এ সবই চলছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এমন অভিযোগ ময়মনসিংহের সদর উপজেলার ভাবখালী এলাকার আ: রশিদ, গৌরীপুর উপজেলার অনন্তগজ্ঞ গ্রামের সিএনজি চালক বাবুল মিয়া, নান্দাইল পৌর এলাকার ব্যবসায়ী সিরাজুল হকসহ অসংখ্য ভুক্তভোগীর।
তবে এসব অভিযোগ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তারা। প্রতিষ্ঠানেরসহকারী পরিচালক আ: খালেক বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের জানা নেই। অভিযোগপেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভুক্তভোগীদেরঅভিযোগ, ময়মনসিংহে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিআরটিএর প্রতিটিসেবা খাতে প্রকাশ্যে চলছে দুর্নীতি। আর্থিক লেনদেনে জেলার বিভিন্ন অভ্যন্তরীন রুটে চলাচলকারী আনফিট গাড়ি গুলোকে পরিদর্শন না করেই ফিটনেস সাটির্ফিকেট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীরের বিরুদ্ধে। সেই সাথে ড্রাইভিং পরীক্ষার নামে লোক দেখানো উপস্থিতি দেখিয়ে অদক্ষ চালকরা নির্দ্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে হাজিরা দিয়ে ইহাতে পাচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কারণে ময়মনসিংহ বিভাগীয় সড়কগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য দূর্ঘটনায় সড়কে ঝরছেশত-শত তাজাপ্রাণ। সূত্রমতে, গত ৮ আগস্ট ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় বাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানসিএনজিচালিত অটোরিকশার ৭ যাত্রী। গত ১৮ আগস্ট ফুলপুরের বাশাটি এলাকায় ট্রাক-মাইক্রোবাসনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাণ হারায় ৮ যাত্রী। গত ২২ আগস্ট ভালুকা উপজেলায় এভাবেই ঝরে গেল আরো৬টি তাজা প্রাণ। এছাড়াও সম্প্রতি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকা সরকারি কলেজের সামনেবাস চাপায় ৬জন নিহত হয়। গত ২৮ আগস্ট ভালুকা এবং মুক্তাগাছায় ট্রাক ও প্রাইভেটকার চাপায় মারাযায় দুই মোটর সাইকেল আরোহী। এসব সড়ক দূর্ঘটনার নেপথ্যে চালকদের অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল।
পুলিশেরদেয়া তথ্য মতে, গত এক বছরে ময়মনসিংহ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৭৫টি,নিহত হয়েছে ১৯৩জন এবং আহত হয়েছে ১৭৪জন। এসব দূর্ঘটনার অনুসন্ধানে দেখা গেছে ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অদক্ষ চালকদের গাড়ী চালানোর লাইসেন্স প্রদান।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে একাধিক অফিস সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মটরযান চালকদের পেশাদারিত্ব ওদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশন বাবদ প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা সরকারীভাবে বরাদ্দ দেয়া হলেও কোন ধরনের প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশন করা হয় না। কিন্তু ভুয়া বিলভাউচারে ওই সব বরাদ্ধের টাকা করা হয় আত্মস্বাৎ। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় টাকা দিলে পাশকরানোর নামে বাণিজ্য, ব্যবহারিক পরীক্ষায় হাজিরা দিলেই মিলছে লাইসেন্স। সূত্রজানায়, প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক ও মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীরের যোগসাজসে নিয়মবহির্ভূতভাবে বহিরাগতদের দিয়ে অফিস করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।ভুক্তভোগীরা জানায়, ব্যাংকে সরকারি ফি দিয়ে কাগজপত্র জমা দিতে গেলে অফিসের মোটরযান পরিদর্শকের নিজস্ব খলিফারাবিভিন্ন আজুহাত দেখিয়ে সেই কাগজ ঠিক করার নামে মোটা অংকের ঘুষ দাবী করেন। এভাবে মালিকানা বদলিসহ নানা কাজে ‘কোটি কোটি টাকাবাণিজ্য’ চলছে প্রকাশ্যে।
সূত্রমতে,একটি মোটর সাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে ব্যাংকে সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার পরও অফিসখরচ হিসেবে দিতে হয় এক হাজার টাকা। ফিটনেস বাবদ প্রাইভেটকার এক হাজার টাকা,মাইক্রোবাস দেড় হাজার টাকা। ট্রাক বা পিকআপ ভ্যান তিন হাজার টাকা, বাস ৫ হাজার টাকাএবং লাইসেন্স নবায়ন করতে এক হাজার, ভারি যান রুট পারমিট পেতে দুই হাজার টাকা দিতে হয়,মালিকানাবদলির ক্ষেত্রে দেড় হাজার টাকা। আর দুর্ঘটনার রিপোর্ট প্রদানকালে দিতে হয় ৫ থেকে ১০হাজার টাকা। আর এসবই হয় অফিস খরচ নামে।
ময়মনসিংহেকার্যালয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা আবু তালেবের অভিযোগ, এ অফিসে ঘুষ ছাড়া গাড়ীরনতুন বা নবায়ন লাইসেন্স হয় না। তাও নিজে করতে গেলে পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা। দ্বারস্থহতে হয় দালালদের।
তিনি দাবি করেন, যে কোন কাজের ঘুষে টাকা দালালরা নির্দ্দিষ্ট হারেজমা দেন মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীরের কাছে। পরে ওই টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়।
আনিছ নামে এক গ্রাহকের অভিযোগ, আমার একটি ভারিলাইসেন্সের জন্য নয় হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কারণ ঘুষ ছাড়া কাজ হবে না, তাই হয়রানী এড়াতেটাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে বাধ্য হয়েছি।
ময়মনসিংহবিআরটিএ’র ঘুষ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য সাদ্দাম বলেন, আমি সরকারী ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত না,তবে অফিসের কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে গত দুই বছর যাবত কাজ করছি। এক্ষেত্রে তার কাজেরবিনিময়ে বেতন-ভাতা কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
অভিযোগ রয়েছে, মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ময়মনসিংহ অফিসে র্দীঘ সময় ধরে কর্মরত আছেন। কিছুদিনআগে তার বদলীর তালিকায় নাম উঠলেও তিনি নিজের ভাই এবং এক অতিরিক্ত সচিব ও কিশোরগজ্ঞেরক্ষমতাসীন দলের এক নেতার ঘনিষ্ট পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ময়মনসিংহে তার নিজেরঅবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন স্থানের চোরাই ও ঝামেলা যুক্তগাড়ীর নিবন্ধন প্রদানে জন্যও একটি সিন্ডিকেট রয়েছে মোটরযান পরিদর্শক সাইফুলের। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ একাধিক সূত্রের।
এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীর বলেন, অফিসে কর্মরত রুকন, সাদ্দাম, সুব্রত, বিজন ও সফলদের বিষয়ে উপ-পরিচালকসাহেব বলতে পারবেন। এ সময় তিনি অন্য কোন বিষয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।