১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া যাযাবর জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে এখন ব্রুনাইয়ে আমার বাস। এই ২৭ বছরে চাকরীর সুবাদে এবং ছুটি কাটানো মিলিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে। অন্তত প্রায় চল্লিশটি দেশে ভ্রমণের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা মাথায় ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। লিখে সবার সাথে share করতে খুব ইচ্ছে করে। ভাবছি লিখবো ধারাবাহিক ভাবে। অন্তত নিজের সঞ্চয়ে রেখে ভবিষ্যতে নস্টালজিয়ায় ভোগার জন্য হলেও। বয়স বাড়ছে অনেক কিছু ভুলেও যাচ্ছি। আমার কাছে মনে হয় আমরা মানুষরা খুবই বিচিত্র প্রাণী। কখনো খুব মায়ায় ভরা, কখনো নিষ্ঠুর, কখনো কোমল, কখনো হিংস্র প্রাণীর চেয়েও ভয়ংকর। আমার অভিজ্ঞতায় এর সবেরই মিশ্রণ আছে। এ বিষয়ে পরে কোন এক সময় লিখবো।
স্কুল জীবন থেকেই মিছিলে মিটিঙে বন্ধু বাৎসল্যে নেতৃত্বে কি প্রাণবন্ত মোহময় জীবন ছিল আমার। প্রাচুর্যে বর্তমানের সাথে তুলনাহীন হলেও ওই জীবনকেই মিস করি। নস্টালজিয়ায় ভুগি। ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে খুব কোমল মনের মানুষ মনে হলেও ছোট বেলা থেকেই ব্যতিক্রমী এবং প্রতিবাদীও ছিলাম, বিশেষ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সে কারণেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে, ঢাকায় পেশাজীবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি ওতপ্রোতভাবে। আহ কি সেই উত্তাল মজার জীবন। ওই জীবনকেই ভালোবেসে থাকতে চেয়েছিলাম। তবে সকল কাজের কাজী আমার জীবন সঙ্গিনী (লাভলী) সঠিক ভাবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে প্রকৃচি আর পেশার আন্দোলনে এবং প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় হোমড়া চোমড়াদের সাথে উঠবস করার মধ্যে একধরণের পুলকিত হওয়া বা মজা থাকলেও পরিবারের সঞ্চয়ের হিসাবে তেমন কিছুই জমা হচ্ছিলো না। অনেকটা সারা জীবন ফিল্মে অভিনয় করে চিকিৎসার জন্য টাকা না থাকার মতো অবস্থা। চাকচিক্য আছে আর্থিক নিরাপত্তা নেই। অবশ্য আমার জায়গায় অন্য অনেকে হলে হয়তো দুটোই হয়তো হতো। আত্মীয়রা বলতো আমাকে দিয়ে হবেনা।
আজ লিখতে বসেছি ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যক্ষ করা একই ধরণের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিন দেশে তিন রকমের ব্যবস্থা সম্পর্কে। আইনের বিধান প্রায় একই হলেও প্রয়োগের ভিন্নতা বিচিত্র। তিনটি দেশ হলো বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রুনাই। আসলে তিন দেশের বাসিন্দা হিসেবে আমাকে মেনে নিতে হয়। অপার সম্ভাবনা আর জন্মগত ভাবে ভালোবাসার দেশ বাংলাদেশ। নিজেকে স্বচ্ছ অর্থে সাফল্য আর পরিবারের সকলের দৃশ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দক্ষ প্রবাসী হিসেবে আবেদনের মাধ্যমে পাওয়া নাগরিকত্বের দেশ অস্ট্রেলিয়া। সবশেষে অঢেল পেট্রলিয়াম আর খনিজ সম্পদ আর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে পরিপূর্ণ রহস্যময় দেশ ব্রুনাই। এই দেশটির প্রতি একটি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল আশির দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়। শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশ কলোনি মুক্ত হওয়া দেশের চমকপ্রদ খবর পড়ে মনের কোনে এক ধরণের ভালোবাসা জন্মে ছিল সেই তখন থেকেই। অবশ্য তখন সেটি ছিল সম্পূর্ণ অবাস্তব কল্পনা। অনেকটা উঠতি বয়সে সিনেমার নায়িকাকে ভালোবাসার মতো। কোনো দিন ব্রুনাই আসবো তা হিসাবে মিলাতে পারিনি। তবে আমাদের কল্পনায় সীমাবদ্ধতা আছে, গণ্ডি আছে। সৃষ্টিকর্তা অসীমের খবর জানেন। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার আরো অনেক প্রার্থনা বাস্তবায়নের মতো এটিও আমার জন্য তখনই লিখে রেখেছিলেন। না হলে আমার ব্রুনেইতে আসার এমনকি অস্ট্রেলিয়া যাবারও কথা ছিলোনা।
তিন দেশের তিনটি ঘটনার সারসংক্ষেপ :
ঘটনা ১, ঢাকা, বাংলাদেশ :
বেশ কয়েকবছর আগের ঘটনা। সপরিবারে ছুটি কাটাতে দেশে গিয়েছি। দুই সপ্তাহের ছুটির সময়গুলি যাতে সঠিক ভাবে কাটানো যায় সে জন্য একটি ভালো গাড়ী ঠিক রাখার জন্য আমার এক আত্মীয়কে আগেভাগেই বলা ছিল। যথারীতি গাড়ী এয়ারপোর্ট থেকে পিক আপ করলো। তারপর সেই একই গাড়ীতে জামালপুর ময়মনসিংহ ঘুরে ঢাকায় দেখা সাক্ষাৎ করা বাজার করা সবই হচ্ছিলো। বিপত্তি ঘটলো একদিন সকালে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর থেকে ৪ নম্বর সেক্টরে যাওয়ার সময় একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ী থামালেন। তারপর ড্রাইভার কে নেমে আসতে বললেন। ড্রাইভার বাইরে গিয়ে সার্জেন্টের সাথে অনেকটা সময় ধরে কথা বলার পরও ফেরত আসছিলনা দেখে আমি নেমে গেলাম। ট্রাফিক সার্জেন্ট আমাকে বললেন, ভাই আপনাকে অন্য গাড়ী ভাড়া করে যেতে হবে কারণ আমরা এই গাড়ী থানায় নিয়ে যাবো। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন যে দেখেন এই গাড়ী এখনো Rego নম্বর পায়নাই। আবেদন করেছে এবং ONTEST sign দিয়ে চালাচ্ছে। বিষয়টি গত কয়দিনে আমাদের নজরেই আসেনি। আমি সার্জেন্ট সাহেব কে বললাম যে ONTEST sign দিয়ে চালানো বেআইনি হলে এই গাড়ীটি গত কয়েক মাস যাবত রাস্তায় চলছে কি করে? সার্জেন্ট সাহেব আমাকে বললেন ভাই আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিদেশে থাকেন ( কিভাবে যেন দেশে গেলে আমাদেরকে বুঝে ফেলে যে আমরা দেশে থাকি না। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে)। আপনি যে দেশে থাকেন সেখানে কি ONTEST sign লাগিয়ে গাড়ী রাস্তায় চলে? বললাম না, সে রকম নিয়ম নেই। তবে গাড়ী কিনে এক দিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশন ট্রান্সফার করা হয়ে যায়। তাই সমস্যা হয়না। বললাম আমি অস্ট্রেলিয়াতে থাকি। সেখানে ONTEST sign লাগিয়ে কেউ গাড়ী রাস্তায় নামানোর কথা চিন্তাও করবে না। আইনটি যদি বাংলাদেশেও তাই হয় তাহলে এর প্রয়োগ নেই কেন? সার্জেন্ট নাছোড় বান্দা। গাড়ী থানায় নিয়ে যাবে। আমি পড়ে গেলাম বিপদে। ৯ সিটের গাড়ী ভর্তি ছোট বাচ্চা সহ লাভলী এবং আমাদের কিছু আত্মীয়। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে এইভাবে বেআইনি sign দিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে? ড্রাইভারের জবাব পরিষ্কার,” স্যার গাড়ীর Rego নম্বর পেতে অনেক দেরি হয় সেজন্য নতুন বা প্রায় নতুন ভালো গাড়ী রোড পারমিট নিয়ে অনেকেই চালায়। আমার কাছে মনে হলো এটি আইন সম্মত না হলেও বাংলাদেশে এটি একটি Norm. আমি সার্জেন্ট সাহেব কে বললাম আমি এব্যাপারে এখন confused, তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশ এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার এক বন্ধু এবং আর এক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইকে ফোন করার কথা বলে মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়েছি। তাদের নাম শুনতেই সার্জেন্ট সাহেবের সুর সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে গেলো। এবার ভাই থেকে আমাকে sir বলা শুরু করলেন। আমাকে ফোনটি না করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেন। তারপর বললেন sir ঠিক আছে আপনি তো দুদিন পরে চলেই যাবেন। অসুবিধা নাই। এই গাড়ী নিয়েই চলতে থাকেন। আমি তখন তাকে বললাম আইন যদি ভঙ্গ করে থাকে ড্রাইভার তাহলে তাকে এভাবে ছাড়বেন কেন। জবাব না দিয়ে বলেলন আপনার সমস্যা হোক তা চাই না। সেই সাথে তার একটি বিজনেস কার্ড দিয়ে আমাকে বললেন সম্ভব হলে আমার নাম টি আপনার বন্ধুকে একটু বলে যাবেন। সার্জেন্ট সাহেব সালাম দিয়ে বিদায় হলেন। গাড়ীতে উঠার পর লাভলীর প্রশ্ন কি এতো কথা, এতো দেরি হলো কেন বাইরে। আমরা যে কি ঝক্কি পার করলাম গল্পের মোহে তা তারা টের পায়নি। এই ঘটনা টি বাংলাদেশের আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে শৈথিল্য, অপব্যবহার, ক্ষেত্র বিশেষে আইনের প্রয়োগ এবং সর্বোপরি আইন ভঙ্গের সংস্কৃতির একটি চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এটি শুধু পরিবহন আইন নয়, সব ক্ষেত্রেই। কোনো preventative measure নাই। ঘটনা ঘটার পরে চেক করার মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, অর্থ পাচার সবই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ধরা পড়ার খবর। অবশ্য আগে সেই ধরা পড়াটাও ছিল না। পরিদর্শন ও তেমন ছিল না। এখন অন্তত চেক হচ্ছে, ধরা পড়ছে, অনেক প্রভাবশালীরাও বিচারের আওতায় আসছে, তড়িৎ বিচার কার্যকরী হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। এখন প্রয়োজন আইন প্রয়োগের স্থিতিশীল প্রিভেন্টাটিভ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন। “Preventative Action, Not Reaction after the Incident “আইন প্রয়োগের এবং মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। আর এতে সরকার, ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান, আইন প্রয়োগ কারী সংস্থা সর্বোপরি জনগণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঢালাওভাবে শুধু এক পক্ষকে দায়ী করার সুযোগ নেই। অস্ট্রেলিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান খাবারে ভেজাল দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না। কারণ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বা কর্মচারীরা নিজেদের পণ্যের মান নিশ্চিত করতে চায় , আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কালো তালিকা থেকে বাঁচতে চায় । খাদ্য প্রস্তুতের আগেই নিয়ম মাফিক প্রাতিষ্ঠানিক পরিদর্শন হয়ে থাকে এবং জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একজন আইন ভঙ্গ করলে কেউ তাকে সমর্থন করবে না। আইন মানার এই সংস্কৃতিটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানেও যে আইন অমান্য হয়না তা নয়। তবে মাত্রাটা কম।
ঘটনা ২, ব্রুনাই :
সম্প্রতি কোন এক সন্ধ্যায় Gym থেকে ফিরছি। সম্ভবত ক্লান্তির কারণে গাড়ীর হেড লাইট অন করতে ভুলে গেছি। একটি সিগনালে পুলিশ আমাকে ইশারা করে কি যেন বলছিলো। গাড়ী স্লো করে কাছে যেতেই বললো “প্লিজ টার্ন অন হেড লাইট” . আমিও ধন্যবাদ দিয়ে, হেড লাইট অন করে চলতে থাকলাম আর ভাবলাম এই ঘটনাটি সিডনিতে ঘটলে আমাকে অন্তত তিনশত ডলার ফাইন গুনতে হতো আর তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট হারাতে হতো। আসলে ব্রুনাইয়ের রোড রুলস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি মজার বিষয় হলো যে এখানে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, খুব কম মানুষই ইচ্ছে করে আইন অমান্য করে। মানুষ খুবই ধৈর্যশীল। রাস্তার মাঝখানে গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলেও হর্ন বাজাবে না পিছন থেকে। ধরে নেবে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। যে কারণে আমার হেড লাইট অন না করার বিষয়টি পুলিশ ধরে নিয়েছে যে এটি একটি অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম অপরাধের জন্য সাধারণত মৌখিকভাবে সতর্ক করে। আর একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা যে গত ৫ বছরে আমাকে বা আমার ড্রাইভারকে কোনো ফাইন দিতে হয় নাই। আমি জানি যে আমি এবং ড্রাইভার দুজনেই অনেক সময় হয়তো ওভার স্পিড করেছি। তবে কখনো কোনো নোটিশ পাইনি। এখানে আইন ভঙ্গ করলে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। আর কেউ রুক্ষ হলে অন্যেরা তা ভালো চোখে দেখেনা। স্বাভাবিক কারণেই মানুষ চেষ্টা করে ভালো থাকতে। আর ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা মানুষকে ভালো থাকতে উদ্ভোদ্ধ করে। এই সংস্কৃতিটা খুব উপভোগ করি।
ঘটনা ৩, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া :
দু'বছর আগের ঘটনা। ব্রুনাই থেকে মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে ট্রানজিট হয়ে সিডনিতে পৌঁছেছি সকাল ৯ টার দিকে। ছেলে প্রসা এয়ারপোর্টে রিসিভ করেছে। প্রতিবারের মতো এবারেও এককাপ কফি, একটি টোস্ট, বাটার আমার জন্য গাড়ীতে রাখা। প্রসার অনেক বিষয়ের মধ্যে এটিও একটি স্টাইল যা লাভলী আর আমার খুব পছন্দের। সব সময় আমাদেরকে পিক আপ করার সময় এই কাজটি করে। ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার প্রশংসনীয় একটি উপায়। যাই হোক গাড়ীতে উঠার পর প্রসা বললো ওকে university (UNSW ) তে যেতে হবে। ক্লাস আছে। যথা রীতি uni তে নেমে যাবার পর আমি ড্রাইভ করছিলাম। কোনো এক পর্যায়ে হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমি সিডনির রাস্তায় না ব্রুনাইতে। M4 এ পিছন থেকে সিগন্যাল দিয়ে পুলিশ থামালো। যথারীতি অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে ৩৫০ ডলার ফাইন লিখে এবং ৩টি ডিমেরিট পয়েন্ট দিয়ে নোটিশ ধরিয়ে দিলো। কারণ আমি অনেক বেশি স্পিড করছিলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। রাতে লাভলী, প্রসা আর এশা (আমাদের মেয়ে)কে ঘটনা বলতেই সমস্বরে তিন জন বলে উঠলো “এটি তোমার ব্রুনাই না। সিডনিতে তোমার গাড়ী চালানো বন্ধ।” তারপর থেকে আজ পর্যন্ত নেহায়েত অপারগ না হলে আমাকে সিডনিতে গাড়ী চালাতে দেওয়া হয়না।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এই তিনটি ঘটনা প্রমাণ করে তিন দেশের আইন প্রয়োগের সংস্কৃতি।
১. আইন আছে তবে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে তো নয়ই। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। সাধারণ জনগণ, প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলি এবং কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের মতো করে আইনের ব্যবহার করতে পারে। তবে সাম্প্রতিক কালে বর্তমান সরকারের গৃহীত শক্ত এবং তড়িৎ পদক্ষেপ হয়তো আইন মানার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতে।
২. মানুষ এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যদি আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে তবে আইন অমান্য করা সকলের জন্য প্রায় অসম্ভব হতে পারে।
৩. আইন আছে যার যথা রীতি প্রয়োগও আছে। তা সে প্রধান মন্ত্রীর ছেলে হোক (কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী জন হাওয়ার্ড এর ছেলেকে ট্রাফিক আইনে ফাইন করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল), অথবা মন্ত্রী হোক (কয়েক মাস আগে নিউ সাউথ ওয়েলস এর প্রাদেশিক মন্ত্রী covid ১৯ আইন অমান্যের কারণে ফাইন দিয়েই শেষ হয়নি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে), কিম্বা প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী হোক (কয়েক বছর আগে এক বোতল মদ বেআইনি উপঢৌকন হিসেবে গ্রহণ করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে বেরি ও’ফারেল)। সম্প্রতি প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী গ্লাডিস বেরেজিকলিয়ান বন্ধু নির্বাচনে ভুলের জন্য পদত্যাগের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো আইন প্রণয়নের চেয়ে চলমান আইনের প্রয়োগ এবং প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের, কর্তা ব্যক্তিদের সেই সাথে বিশেষ করে সাধারণ জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা বেশি জরুরী। রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পুরনো নিয়ম ভেঙে নতুন সংস্কৃতি তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে ১০ থেকে ৩০ বছর সময় লাগে। সেই সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে না পারলে প্রয়োজনের সময় তা বুমেরাং হতে পারে তা সবার জন্যই।
আর একটি সত্য ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। ঘটনা কাল ১৯৯৩। স্থান : ঢাকায় আমাদের তৎকালীন সরকারী এপার্টমেন্ট। লাভলী এবং আমি দুজনেই তখন ঢাকায় কর্মরত। কোন এক বিকেলে লাভলীর বস এসেছেন আমাদের বাসায় চা খেতে। সাথে তার দুই ছেলে। বড়টির নাম ভুলে গেছি। ছুটটির নাম মনে আছে - সৌরভ। বেল টিপতেই বাসার কর্মচারী মিনা দরজা খুলে লাউঞ্জ রুম এ বসতে দিয়েছে। রুম এ ঢুকেই সৌরভ তবলায়, আর তার ভাই হারমোনিয়াম এ গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাজানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। মীনা দৌড়ে এসে লাভলীকে হাঁপাতে হাঁপাতে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শুরু করেছে “আফাগো শিগগির আহুইন, সব শেষ কইরা ফালাইলো”। আমরা দুজনেই দৌড়ে গিয়ে দেখলাম দুই ভাইয়ের কসরত তখনো চলছে। আর লাভলীর বস বলে চলছে সৌরভ “হালকা হালকা”। বস অপ্রস্তুত, লাভলী নিজের ভালো লাগার সংগীত উপকরণ রক্ষায় কিছুই বলতে পারছে না, যদি বস অখুশি হয়ে পড়েন। ৫-৭ বছরের ওই দুই ছেলেকে ছোট বেলা থেকে প্রকৃত শিষ্টাচার, অন্যের জিনিস ব্যবহারের আগে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং সময়মতো শাসন করার শিক্ষা হয়তো দেওয়া হয়নি বলেই ওদের বাবা আমাদের সামনে অপ্রস্তুত কিংকর্তব্য বিমূঢ়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আর পারিবারিক ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই মিল আছে। সময়মতো দুষ্টকর্মের নিয়মমাফিক বিচার না করলে বা শিক্ষা না দিলে প্রয়োজনের সময় তারা কথা শুনতে চাইবে না। তখন জটিলতা সৃষ্টি করবে। অনেক ভালো কাজগুলি গুটিকয়েক উশৃঙ্খল ব্যাক্তির জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটিই স্বাভাবিক।
লেখক: সিইও, ঘানিম ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (ব্রুনায় হালাল ফুডস), ব্রুনায়