সব সময় ভাবী এক রকম, হয় আরেক রকম। লিখতে চাই একটা, লেখা হয় আরেকটা। ঘটনার পর ঘটনা ঘটতে থাকে। মুসলমান হিসেবে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আমার ইমান ও আনুগত্য পারিবারিকভাবেই নিঃশর্ত। একটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারে জন্ম নিলেও আমার পরিবার ও সমাজ অসাম্প্রদায়িকতার পাঠ দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কী আমি জানি না। ধর্মের তর্কযুদ্ধেও যাই না। সব ধর্ম নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা আমার নেই। অনেককে দেখি এককালের তাত্ত্বিক বামের অহংকারী ফ্যাশন চর্চার মতো নাস্তিক বলে দাবি করেন। এতেও আমি মাথা ঘামাই না। এসব তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। আমার কিছু যায় আসে না। কেউ বা আবার ধর্মের পোশাকে আচরণে বেশ উগ্র, দম্ভ নিয়ে হাঁটেন, যেন তিনিই শ্রেষ্ঠ মুসলমান। এটাও আমি গুনি না। আল্লাহই জানেন কার পরিণতি কী। শেষ বিচারের মালিক তিনি। কিন্তু কারও ধর্মীয় বিশ্বাস অনুভূতিতে আঘাত গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মের নামে সহিংসতা হানাহানি বিদ্বেষকে ঘৃণ্য অপরাধ মনে করি।
শ্রেষ্ঠ মহামানব শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তিনিই মুসলমানদের ফিলোসফার, পথপ্রদর্শক। বিভিন্ন ধর্মের কত জগদ্বিখ্যাত মানুষও তাঁকে সম্মান করেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের পর রসুলের কথাই শেষ কথা। ধর্মের সুললিত শান্তির বাণী অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। আল্লাহ, রসুলের প্রতি আনুগত্য আর নামাজ রোজা হজ জাকাত পালন করা যদি হয় সাম্প্রদায়িকতা তাহলে ধর্মের নামে পাকিস্তানি শাসকদের ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ জীবন যৌবন উৎসর্গ করে জান বাজি রেখে জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম করত না নির্ভীকচিত্তে। ইতিহাসে সেদিন পাকিস্তানের স্বঘোষিত ইসলামপন্থি বড় বড় নেতারাই নিশ্চিহ্ন হননি, তাদের আজ্ঞাবহ দলও অস্তিত্ব হারিয়েছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সাম্প্রদায়িক নয় বলেই ’৭১ সালে নির্বাচিত জাতির একক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামরিক অভিযানকে আমলেই নেয়নি। বিশ্বমোড়লদের পাকিস্তান-প্রীতি ও সমর্থনকে দুই আনা মূল্য দেয়নি। গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ ও তাদের মহান নেতা ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়, আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা যেমন ছিল তেমনি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের সমর্থন। ’৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর সাম্প্র্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোও একটি অংশের ভোট পেয়েছিল। সেই ক্ষুদ্র অংশটি একাত্তরেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভূমিকা রাখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালাল ক্রীতদাসরা সেদিন মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা বীর ও সমর্থকদের হিন্দুস্থানের দালাল বলেছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া, সমর্থন করাদের ইসলামের দুশমন বলে তাদের ধরিয়ে দেয়। অবর্ণনীয় নির্যাতন করা, নৃশংস গণহত্যা করা, নারীদের ধরে এনে গণধর্ষণ করা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জাহান্নাম করেছিল।
ইসলামাবাদের রাষ্ট্রপতি ভবনকে বেশ্যালয় বানিয়ে মাতাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মদ ও নারীতে ডুবে বর্বর জঘন্য গণহত্যা ও গণধর্ষণে উল্লাস করেছিল। জাতির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগারে একা নির্জন সেলে বন্দী করে ফাঁসি দিতে কবর খুঁড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের গণহত্যা ও গণধর্ষণের পরিণতি করুণ পরাজয় ও আত্মসমর্পণে শেষ হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস গৌরবের ত্যাগের রক্তের ইতিহাস। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্তে এ মাটি ভেজা। বীরত্বের ইতিহাস লেখা। সেই যুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু- সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ গেছে। ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়েছে। সেদিন বিশ্বমোড়লদের সঙ্গে পূর্বের চীন আর মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিও পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে। সোভিয়েত-ভারতসহ যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তারা মুসলমান নয়। রাষ্ট্রের জন্ম আমাদের মানবতার আদর্শ দিয়েছে। ধর্মকে ব্যক্তিজীবনের চর্চার শিক্ষা করেছে। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সংবিধান কেটেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ এনেছে, তারা খুনির ভাই, দেশের বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রের শত্রু। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ঠাঁই পেয়েছিল। এটাই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের গণজাগরণ ও স্বাধীনতার বড় অর্জন। কিন্তু ’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের মিত্ররা পরাজয়ের দহনে এতটাই পুড়ছিল যে এ বিজয় মেনে নিতে পারেনি। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে অসাংবিধানিক অবৈধ খুনির শাসন কায়েম করে একে একে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মহান আদর্শ নির্বাসনে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে বিশ্বাসঘাতক খুনিরা ক্ষমতায় গেছে আর ’৭১-এর পরাজয়ের গ্লানি বহন করা দেশগুলো একে একে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রের আদর্শ ও আত্মাকে হত্যা করেই তারা সেদিন তৃপ্ত হয়নি। বিজয়ের আনন্দ ভোগ করেছিল। অথচ এটা ছিল বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে ঘটে যাওয়া মানবসভ্যতার সবচেয়ে বেদনাদায়ক হত্যাকা-। মানবিক শক্তির মহান নেতা শোষিতের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে তারা আনন্দ করেছে। ’৭০ সালের নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই ’৭১ সাল থেকে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে এ দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ধর্মের নামে ফের রাজনীতির পতাকা উড়িয়েছে, সাংগঠনিক কর্মকা- করেছে, পাকিস্তানি আইএসআইর পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েছে এরাই বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক অপরাধী শক্তি। আল্লাহ-রসুলের ভক্ত হলেই, ধর্ম পালনে ইবাদতে মগ্ন হলেই সাম্প্রদায়িক নয়। ধর্মান্ধ নয়। জঙ্গি নয়। ব্যক্তিগত জীবনে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান আর রাজনৈতিক জীবনে যারা সব ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় পারিবারিক সামাজিক বন্ধনে বাস করে তারাই দেশপ্রেমিক। এ দেশের জন্মটাই অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানের দাসরা কখনো দেশপ্রেমিক নয়। এরা সর্বনাশা আগুন নিয়ে খেলে। সাম্প্রদায়িক উগ্র ধর্মান্ধ সামরিক শাসনে ক্ষতবিক্ষত ব্যর্থ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেতাত্মারাই এ সাম্প্রদায়িক শক্তি। সাম্প্রদায়িক শক্তি সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা করে। ধর্মের নামে বাতাসে হিংস্রতার বিষ ছড়ায়। সমাজকে অশান্ত করে। ওরা অসাম্প্রদায়িক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মনে-প্রাণে মানতে পারে না। ওরা পাকিস্তানি বিশ্বাস লালন করে। ৩০ লাখ শহীদ, আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করেছে আগেই। এখন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানাতে চায়।
এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। এখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সম-নাগরিক অধিকার ভোগ করে। কিন্তু কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা বরদাশত করা হয় না। ইসলাম ধর্ম নিয়ে নাস্তিকতার ফ্যাশনে বিকৃত বক্তব্য লেখার কারণে, জঙ্গিদের হাতে কেউ কেউ নিহত হয়েছেন। এটা দুঃখজনক। ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এসব অন্যায়, বিকৃতি। তেমনি খুনিদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। জঙ্গিদের কঠোর হাতে দমন করেছেন। অনেকে নাস্তিকতার বিতর্ক তুলে বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। যেমন অনেকে দেশে মৌলবাদের তকমা গায়ে মাখিয়ে নিজস্বার্থে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। রাষ্ট্র ও জনগণের সঙ্গে এটা বিশ্বাসঘাতকতা। এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও সাম্প্রদায়িক নয় বলে এখানে সব নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীসহ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির পরাজয়ই নয়, জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়। আইএসআইয়ের নিরন্তর প্রচেষ্টা, মধ্যপ্রাচ্যের সহযোগিতা, এরদোগানের প্রেম বিফলে যায়। এ দেশের জনগণের হৃদয়ে ঐতিহাসিকভাবে যে ঘৃণা ’৭১-এর বর্বরতার জন্য পাকিস্তানের প্রতি এতে আর যাই হোক যেনতেন কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও মানুষের ঘেন্না ও ক্ষোভ মুছে যাবে না। দালাল পুষতে পারে। পাকিস্তান আমলেও ছিল, ’৭১ সালেও ছিল। পরেও ছিল। তাদের পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়েছে। পাকিস্তানের এজেন্টরা যত শক্তিশালী হোক সাময়িক সময়ই তাদের ভোগ। সময় তাদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করবে। আগুন নিয়ে খেলা ছাড়া এদের কোনো শক্তি নেই। আগুন অনেক সময় নিজেকেও পোড়ায়। বিএনপি-জামায়াত আমলেও পুড়িয়েছে। চলমান নানা ঘটনার পর ঘটনা দেখলে প্রশ্ন জাগে, ভয়াবহ আগুন নিয়ে খেলতে দেওয়া যায় না। এ শান্তি, এ উন্নয়ন স্তব্ধ করা যায় না।
একদল তথাকথিত নব্য নাস্তিক বেশ মজাই করছে, ফ্রান্সে কয়েকদিন আগে ব্যঙ্গ রসাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর মহানবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর বিকৃত কার্টুন প্রকাশ করে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করায়। ২০১৫ সালেও এমন বিকৃত কর্মকা-ের কারণে কার্টুনিস্টসহ ১২ জন নিহত হন। এবারও তারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়কে আঘাত করেছে। অনেক জায়গায় রক্ত ঝরেছে। বাংলাদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশাল প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। প্রিয় নবীর অবমাননায় কলিজায় আঘাত পাওয়ার কারণে এ প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত। তবে তারা কোনো উগ্র পথ নেননি। যে আলেম-ওলামারা প্রতিবাদমুখর তাদের চিন্তা করতে হবে প্রতিবাদ যেন হঠকারী পথ না নেয়। ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক তারা নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। কিন্তু বুঝতে হবে কূটনৈতিক সম্পর্ক সহজেই বন্ধ হয় না। আলেম-ওলামারা সুগন্ধি আতর মাখেন। ফ্রান্সের পারফিউম অগণিত নারী-পুরুষ ব্যবহার করে সৌরভই ছড়ান না, চিত্ত প্রফুল্ল রাখেন।
মহানবীর অবমাননার প্রতিবাদকে ব্যবহার করে জগতের মতলববাজ শয়তানরা যেন ভিন্ন খাতে নিতে না পারে। আগুন ছড়িয়ে সমাজকে অশান্তিতে দগ্ধ করতে না পারে। সে জন্য সজাগ সতর্ক থাকতে হবে। দায়িত্ব সবার। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে মানসিক ভারসাম্যহীন নামাজি শহীদুন্নবীকে গণপিটুনি দিয়ে বর্বরতায় ভয়াবহ আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো কেন? কারা করল? আলেম-ওলামাদের কি এসব দেখার বিষয় নয়? এর প্রতিবাদ কেন হলো না? এ খুনিরা কি বেহেশতে যাবে? এ ঘটনার এক দিন আগে জনস্বাস্থ্যের পরিচালক আবদুর রহিম হঠাৎ করে নোটিস দিয়ে বললেন, অফিসে পুরুষরা টাকনুর ওপর প্যান্ট, নারীরা হিজাব পরবেন! যদিও মন্ত্রণালয় সে নোটিস বাতিল করেছে তবু প্রশ্ন। এসব তো আগে ছিল না। যার যা পছন্দ তা পরবে। কেউ তো বাধা দিচ্ছে না। আর সরকারি নির্দেশ সিদ্ধান্ত ছাড়া তিনি দেন কীভাবে? এটা তো ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়? এ কথা বলায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী যে মন্তব্য। অনেকে তো সিনেমার ব্ল্যাকের টিকিট বিক্রেতার মতো আমাকে দোজখে পাঠিয়ে দেন। যেন নিজের বেহেশত নিশ্চিত। আমি বুঝি আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও শেষ বিচারের মালিক। তিনিই জানেন, কার পরিণতি কী? কী হবে মানবিক মুসলমানের পরিণতি, কোথায় হবে ধর্মান্ধ জঙ্গি উগ্র খুনি মুসলমানের জায়গা। কুমিল্লার মুরাদনগরে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে আগুন কি বর্বরতা নয়? আলেমরা প্রতিবাদ করবেন না? সমর্থকদের শান্ত হতে বলবেন না? কোনো উগ্র হঠকারিতার পথ না নিতে বলবেন না? সরকার তো আছে!
আমি মুসলমান, গভীরভাবে ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু যে ইমাম পবিত্র কোরআন শপথ করিয়ে ছাত্রীদের একের পর এক ধর্ষণ করেছে, যে মাদ্রাসাশিক্ষক নিয়মিত ছাত্রদের বলাৎকার করেছে এতে হাশরের ময়দানে কার শাস্তি কী হবে সেটি আমরা জানি? নাকি সর্বশক্তিমান আল্লাহ জানেন। আলেমদেরও এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবী নিরপরাধ মানুষ হত্যার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেলেও যারা ধর্মের নামে ’৭১ সালে, একালে জিহাদের নামে আইএস, জঙ্গিবাদ করে নিরীহ নারী-শিশু হত্যা করেন তারা কি ভুল করছেন না? এ অপরাধের পথকেও পৃথিবীর মুসলমানরা সমর্থন দেয়নি। একসময় আলেমরা সহনশীল ছিলেন। ঘুষ, দুর্নীতি, গিবত, পাপাচারের বিরুদ্ধে বলতেন। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতেন না।
ফরাসিরা গণতন্ত্রের সুকোমল আবির্ভাব ঘটিয়েছে। কত দার্শনিকের উপহার দিয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পৃথিবীর তীর্থস্থান। ফুটবলেও খ্যাতি ছিল। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ভলতেয়ার, রুশোর ফ্রান্স। পিকাসোর শিল্প ইতিহাস। এত সভ্য সুন্দর দেশ। কিন্তু পৃথিবীর শান্তি বজায় রাখতে বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীর মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কেন? এটা বিশ্বকে অশান্তই করে না, জঙ্গিবাদেরও জন্ম দেয়। রাশিয়া যথার্থ বলেছে এসব কার্টুন বন্ধ করতে। পোপও সমর্থন করেননি এ আঘাত। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিরাকও নন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানেই যা খুশি বলা নয়। দায়িত্বশীলতা শব্দটিও রয়েছে। আমরাও বলি ধর্ম ব্যক্তিজীবনে রাখি। রাজনীতি-সমাজ নয়। কারও মনেই ধর্মের আঘাত নয়। শান্তি আজকের পৃথিবীর বড় আকুতি। মানবতাই সেখানে আলো জ্বালাতে পারে।
মহানবীর ব্যঙ্গ কার্টুন ফরাসি সভ্যতাকে উলঙ্গ করেছে। বিশ্বে বিতর্কিত করেছে। এমন জঘন্য কার্টুন বারবার করে তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিশ্বের বিশাল মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের ভিতরের হিংস্র বন্য বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বর্ণবাদ পৃথিবীতে এমনিতেই মুছে যায়নি। এর মধ্যে একটি বিশাল ধর্মের মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করা পৃথিবীতে আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। হিংসার। শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের উগ্রপথ গ্রহণে প্রভোগ করার। বিশ্বনেতাদের এটা ভাবতে হবেই। সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ৭৪ বছর বয়সে চলে গেলেন। তিনি নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার কট্টর সমালোচক। বিশেষ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের সেন্সরশিপের কঠোর সমালোচনা করতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধাভিযানের সংবাদ সংগ্রহ এবং নিরপেক্ষতার মাধ্যমে পরিবেশন করে পৃথিবীকে মুগ্ধ করেন।
নিউইয়র্কের নাইন-ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলার আগুনে কেবল মানুষই মরেনি, মানবতাই আক্রান্ত হয়নি, বিশ্ববাসীর হৃদয় কেঁদেছিল। সে সময় রবার্ট ফিস্কই সাহস করে বলেছিলেন, টুইন টাওয়ারে ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আফগানিস্তানের অভিযানে ৫ লাখ নারী-শিশু মরেছে। ইরাকেও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ধর্মের নামে জঙ্গি হামলাই হোক, আর যুদ্ধ বা দখলের নামে আক্রমণ হোক সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো নিরপরাধ মানুষের করুণ মৃত্যু। লাদেনকে বিশ্বের মুসলমানরা সমর্থন করেনি। তালেবানরা করেছে। পাকিস্তান আশ্রয় দিয়েছ। তার নির্মম পরিণতিতে কারও চোখে অশ্রু দেখা যায়নি। ধর্মের নামে এ সন্ত্রাসের দায় তাকে কেউ দেয়নি। সাদ্দাম, গাদ্দাফির পরিণতিও ভয়াবহ হয়েছে। সিরিয়া আইএসের অভিশাপে অভিশপ্ত। আইএসকে বিশ্বের মুসলমানরা ঘৃণা করেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলমান মানেই জঙ্গি, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী এমনটি যেমন সত্য নয়, তেমনি নিরপরাধ মানুষ হত্যাও গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ক্লিনটন এ দেশকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়েছি। আর সাম্প্রতিককালে ভারতে তার রাষ্ট্রের সৌন্দর্য ধর্মনিপেক্ষতা হিন্দুত্ববাদের ছোবলে আক্রান্ত। পাকিস্তান তো জন্ম থেকেই ধর্মের বিষে বিষাক্ত হয়ে আছে। এ দেশেও জঙ্গিদের ঠাঁই হয়নি। সরকারের অপারেশনে নিহত, ফাঁসিতে ঝুলন্ত জঙ্গিদের লাশও পরিবার নিতে আসেনি। তাই শান্তির পৃথিবীতে মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বসবাস করতে চাইলে যে যে ধর্ম বা মতেরই হোক না কেন তার মতো স্বাধীন জীবন শান্তিতে যাপন করবে। কিন্তু কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে উত্তপ্ত, সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে না। প্রতিটি দেশে আইন আছে। বিচার আছে। আর শেষকালে তো বিশ্বাসীদের জন্য হাশরের ময়দান আছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তিনামা হলো সংবিধান আইন। এর ঊর্ধ্বে কেউ নয়। যে কোনো ইস্যুতে আইন হাতে তুলে নেওয়া বা পরিবেশ অস্থির অর্থাৎ সহিংস করার এখতিয়ার কারও নেই। সরকার নিশ্চয় ফ্রান্স সরকারকে জনগণের অনুভূতিসহ প্রতিবাদ জানিয়েছে বা জানাবে। তাই বলে প্রতিবাদের বাইরে আমরা নিজেরা নিজেরা কোনো সংঘাতে জড়াতে পারি না।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।