#৩ নভেম্বর রাত আমার মনে হয়েছিল কেয়ামতের রাত: মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
#শেখ হাসিনা সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিচ্ছেন: জাহাঙ্গীর কবির নানক।
#বিএনপি জেলহত্যা মামলার প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের খালাস দিয়েছে: কামরুল ইসলাম।
#জাতীয় চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মার বিশ্বস্ত: হাসনাত মিয়া।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করেছিল খুনি মোশতাক এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসাবে কাজ করা আরেক খুনি জিয়াউর রহমান। দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৪৭ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা।
মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং জার্মান দূতাবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনানারি কনস্যুলেট ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। জাতীয় চার নেতাকে এই রাতেই হত্যা করা হয়। আমার মনে হয়, এ রাত কেয়ামতের রাত। পৃথিবীর ইতিহাসে জেলখানার হত্যাকাণ্ডের এমন ঘটনা বিরল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৮ দিন পরই আমাদের ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ কামালের শশুড়কে নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করেছিল। আমরা নিউ জেলে গিয়ে ২৩ জন মিলিত হই। ব্রিটিশ আমলে এটা ছিল ঘোড়া রাখার স্থান। পাকিস্তান আমলে এটা ছিল গোডাউন। ওই সময় জেলখানা প্রায় পরিপূর্ণ। তাই এই গোডাউনকেও জেলখানায় পরিণত করা হয়। আমরাই সেখানে কয়েদি হিসাবে গিয়েছিল। তিনটা রুম ছিল সেখানে। আমাদের ২৩ জন মিলে সেখানে থাকতাম। ৩ নভেম্বর রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে রয়েছি। শেষ রাতে সাইরেন আর কাক আর চিলের আওয়াজে ভয়ানক এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এর কয়েক মিনিট পর আর্মিদের বুটের আওয়াজ পাই। নিউ জেলের রাস্তায় যে লাইটটা ছিল, সেটিও বন্ধ করে দিয়েছিল। সুবেদার ইদ্রিস প্রথম রুমটা খুলেই বললো, জাতীয় চার নেতা ছাড়া সবাই বেরিয়ে আসতে বললেন। অন্য সবার সাথে তাজউদ্দীন সাহেব বের হয়ে গিয়েছিলেন। তখন ইদ্রিস তার হাত ধরে আবারো রুমে নিয়ে যায়। ৩ নম্বর রুম থেকে ক্যাপ্টেন মনসুর আহমেদকে ১ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আমাদের রুমে এসে আসে সুবেদার ইদ্রিস। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে। সে শুধু বললো, আর্মি। তখন কামরুজ্জামান সাহেব তাহাজ্জুদের নামাজ পরছিলেন। এরপর তাকেও ১ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর জাতীয় ৪ নেতাকে ১ নম্বর রুমে নিয়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকশ রাউন্ড গুলি করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা চলে যায়। কয়েক মিনিট পরই আমরা গোঙানির আওয়াজ পাই। পানি পানি বলে আওয়াজ করছিলেন। তারপর জেলের রুমে বসা। একজন মারা যায়নি, এটা শোনার পর আবারো ১০ মিনিট পর গুলির আওয়াজ। তখন আমরা ভেবেছিলাম আমাদেরও হত্যা করা হবে। এরপর আবারো ক্যাপ্টেন মনসুরকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা নিশ্চিত করে। তখনই ফজরের আযান পরে। আমরা তখন রক্তের একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের সমন্বয়ে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা এদেশ স্বাধীন করেছিল, তারা বেঁচে থাকলে ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা বাস্তবায়ন হবে না। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অনেক ঘটনা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। এটা এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে, ওই ৫ দিন কি ঘটেছিল তা জানার। জেলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে ঠিকই কিন্তু পরিকল্পনাকারীর বিচার এখনো হয়নি। তাদেরও বিচার করতে হবে।
জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক অজানা তথ্য এখনো বের হয়নি। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আল্লাহর অশেষ রহমতে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ভাবে এক স্রষ্টা ভেবে রাখেন অন্যকিছু। জেলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে জড়িত। তারা এখনো গোপনে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এদেশে কোনো ষড়যন্ত্রকে আর সফল হতে দিবে না। আওয়ামী লীগ এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় ঐক্যবদ্ধ। বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে যাদের জনগণের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারা অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যেতে ষড়যন্ত্র করছে। তারা এমনভাবে কোনো পরিকল্পনা করে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কারণ শেখ হাসিনা সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিয়েছেন।
এ্যাড. কামরুল ইসলাম বলেন, আমি প্রথমেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহীদ, জেলখানায় শহীদ ৪ নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা শুরু করছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো বিপথগামী সেনাসদস্যদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি। এটা ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তির নির্মম প্রতিশোধ। জিয়াউর রহমান কোনোভাবেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর নিন্ম আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রায় পাই। এরপরই আমরা জেলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ শুরু করি। আমরা একসাথে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জেলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করি নাই। আজকের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সিরাজুল ইসলাম, প্রয়াত সাহারা খাতুন, মোশাররফ হোসেন কাজল সবাই মিলে মামলা লড়েছি। জেলখানা হত্যাকাণ্ডের পরই লালবাগ থানায় মামলা হয়েছিল। তখন মামলাটি আর অগ্রসর হয়নি। এরপর আমরা যখন মামলা লড়ছিলাম, তখনই ২০০১ সালে আবারো বিএনপি ক্ষমতায় চলে এসে মামলাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের ৪ জনকে প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ দেয়ার পর নানা ধরনের প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে। আমাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আমাদের প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের অনুরোধে কাজ শুরু হয়েছিল ঠিকই। আমি তখন নিয়মিত আদালতে যেতাম। আদালতে ১৬৪ ধারায় সাক্ষীরা যে বক্তব্য দিয়েছিল, তার বিপরীত কথা তুলে ধরেছিল সাক্ষীরা। সাক্ষীদেরও নানা চাপে রাখা হয়েছিল। খালেদ মোশারফের ভাই রাশেদ মোশরাফকেও উল্টো কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এরপর আমরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করি। এরপর ২০০৪ সালে এই মামলার ষড়যন্ত্রকারীকে ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান, নুরুজ্জামানকে আমরা বিচারের কাঠগড়ায় আনতে পারিনি। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করতে পারিনি।
ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া বলেন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ভাই এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাইয়ের কথা বলার পর আমার আসলে তেমন কিছু বলার নেই। আমি যখন মতিঝিল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তখন নানক ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমরা তখন স্বপ্ন দেখতাম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। মায়া ভাই যেভাবে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে আমরা গা হিম হয়ে গেছে। আমি আরো একটা কথা বলতে চাই, আজকে জার্মানিতে একজন প্রাদেশিক গভর্নরের সাথে দেখা হয়েছিল। তখন তাকে বললাম আমার আজ ৩ নভেম্বর নিয়ে মিটিং আছে। তখন তিনি আমাকে বলছিলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হত্যাকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করেছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের মতো কোনো ঘটনা দেখি নাই। আমি আজকে আরো একটি দাবি রাখতে চাই, মায়া ভাই এবং নানক ভাইও বলেছেন, এইসব হত্যাকাণ্ডের পেছনেরও কুশীলবদের বিচার হয়নি। তাদের বিচার করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়া চার জাতীয় নেতার পরিবারের পক্ষ থেকে ৩ নভেম্বরকে শোক দিবস এবং ছুটির দিন ঘোষণার দাবি বাস্তবায়নের জন্য আজকের ভোরের পাতা সংলাপের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আহ্বান রাখছি। আমি শেষ কথা হিসাবে বলতে চাই, আমি মনে করি বিখ্যাত হওয়ার চেয়ে বিশ্বস্ত হওয়া জরুরি। জাতীয় চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মার বিশ্বস্ত।