আগুনেলালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থল বন্দরে কোরআন শরীফ ‘অবমাননা’র অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা পর যে ব্যক্তির মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, তার পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহতের নাম শহিদুন্নবী জুয়েল (৪২)। রংপুর শহরের শালবান এলাকায় তার বাড়ি। কাজ করতেন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে। সম্প্রতি তার চাকরি চলে যায়। তার বাবার নাম আবদুল ওয়াজেদ মিয়া। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতেও বুড়িমারী স্থল বন্দরে মারধরের পর পুড়িয়ে হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন জন পোস্ট করছেন। সবাই নিহত ব্যক্তিকে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের সাবেক লাইব্রেরিয়ান শহিদুন্নবী জুয়েল বলে নিশ্চিত করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের আগে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ তুলে শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশ পুড়িয়ে ফেলে বিক্ষুপ্ত জনতা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি করে। ঘটনার সময় মৃতের মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন নেভাতে গেলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তাড়া করে সরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, দুই ব্যক্তি আসরের নামাজের সময় মসজিদে ঢোকেন। নামাজ শেষে তারা মসজিদে অস্ত্র আছে বলে দাবি করেন। এ সময় তারা কোরআন ফেলে দেয় ও অবমাননা করে। এমন অভিযোগে একজনকে ধরে পিটিয়ে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অপরজন পালিয়ে যান।
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আসরের নামাজ শেষে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুই জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি আসেন। মসজিদের খাদেম জুবেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের একজন মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে কোরআন-হাদিসের বই রাখার তাকে অস্ত্র আছে বলে তল্লাশি শুরু করেন। এক পর্যায়ে মসজিদের সামনে থাকা ৫-৬ জন মুসল্লি মসজিদের প্রবেশ করে ওই ব্যক্তিকে এবং বারান্দায় থাকা অপর ব্যক্তিকে মারধর করেন। খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দুই ব্যক্তিকে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষের ভেতরে ঢুকে তালা লাগিয়ে রক্ষার চেষ্টা করি। তবে মুহূর্তে শত শত লোকজন জড়ো হতে থাকে।’
হাফিজুল আরও বলেন, আমি ও স্থানীয় রফিকুল ইসলাম প্রধান নামে এক ব্যক্তি পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মোহন্ত, ইউএনও কামরুন নাহার, উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম নেওয়াজ নিশাতকে ফোন করে ঘটনাস্থলে আসতে বলি। এরই মধ্যে উত্তেজিত জনতা কারও কথা না শুনে পরিষদের দরজা-জানালা ভেঙে এক ব্যক্তিকে বাইরে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ নিয়ে লালমনিরহাট-বুড়িমারী জাতীয় মহাসড়কের বুড়িমারী প্রথম বাঁশকল এলাকায় কাঠখড়ি ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেখানে ৫-৬ হাজার উত্তেজিত মানুষ ছিল, কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি আসরের নামাজ শেষ করে বাইরে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পাই খাদেম জুবেদ আলীকে দুই জন অপরিচিত ব্যক্তি সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে কথা বলছিল। এরপর তারা মসজিদের ভেতরে ঢুকে যায়। আমিও চলে যাই। পরে ঘটনার কথা এসে শুনেছি। কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানি না।’
জানতে চাইলে ওই মসজিদের খাদেম জুবেদ আলী বলেন, ‘আমাকে র্যাব ও আর্মির পরিচয় দিয়ে বলা হয়, কোরআন শরীফ ও হাদিস রাখার তাকে নাকি অস্ত্র আছে। এ কথা বলে তাদের একজন খোঁজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে সবকিছু তছনছ করেন। এসময় মসজিদের বাইরে অবস্থানরত হোসেন আলী (৩৫) নামে এক মুসল্লিসহ ৫-৬ জন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করে দুই জনকে আটক করে বাইরে নিয়ে আসেন। মসজিদের বারান্দার সিঁড়িতে প্রথম দফায় তাদের মারধর করা হয়। পরে হাফিজুল ইসলাম মেম্বার এসে তাদেরকে নিয়ে যায়। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না।’
পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্ত বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনায় বিতর্ক থেকে গুজব ছড়িয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৭ রাউন্ড শর্টগানের ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক আছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভোরের পাতা/এএম