>> ঢাকা থেকে রংপুরগামী বাসকে সড়ক-মহাসড়কে ১ হাজার থেকে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে
>> সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাস ছাড়ার আগে ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০, ৮:২৪ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
সারা দেশের মহাসড়কে ফের সক্রিয় উঠেছে পরিবহন চাঁদাবাজরা। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। চাঁদার টাকা না দিলে গাড়ি থামিয়ে রাখা হয়। মাঝ রাস্তায় যাত্রীদের নিয়ে বিড়ম্বনা এড়াতে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা লাইনম্যানদের হাতে নির্ধারিত চাঁদার টাকা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকরা। শুধু মহাসড়কেই নয়, রাজধানীর সড়কে আবারও শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি। বাস টার্মিনালগুলোতে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কাছে পরিবহন শ্রমিকরা অসহায় হয়ে পড়েছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিভিন্ন পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক নেতারা।
তারা বলছেন, কোথাও চাঁদাবাজি নেই। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয় এমন লোকজনই কোথাও কোথাও চাঁদাবাজির মাধ্যমে এই সেক্টরকে কলুষিত করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মে মাস থেকে পুলিশ প্রশাসন সড়ক-মহাসড়কে পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধের ঘোষণা দেয়। পুলিশের এই উদ্যোগকে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারাও সমর্থন জানান। এরপর পুলিশি তৎপরতা শুরু করে বেশ কয়েকজন চাঁদাবাজকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ ক’জনকে বহিষ্কারও করা হয়। এরপর চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে আসে।
কিন্তু সম্প্রতি আবার চাঁদাবাজরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে পরিবহন চালক ও তাদের সহযোগীরা অভিযোগ করেছেন। উত্তরবঙ্গের সড়ক-মহাসড়কে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন রুটের বাসচালকরা ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে রংপুরগামী একটি যাত্রীবাহী বাসকে সড়ক-মহাসড়কে ক’দফায় ১ হাজার টাকা থেকে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। ঢাকায় টার্মিনালে এক দফা চাঁদা পরিশোধ করে বাস ছাড়ার পর সিরাজগঞ্জ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে চালককে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। সিরাজগঞ্জের পর বগুড়া ও রংপুর মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা আদায়কারীরাও সক্রিয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের নামেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে প্রতিনিয়িত। ঢাকা-মাওয়া সড়ক ব্যবহারকারী বাসচালকরা এ প্রতিবেদককে জানান, মাওয়া ও ফরিদপুরে তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে বাস ফেরিতে উঠতে দেওয়া হয় না। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান বাস টার্মিনালে বেশ ক’মাস চাঁদাবাজদের দেখা মেলেনি। কিন্তু সম্প্রতি সব ধরনের পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় চাঁদাবাজরা আবারও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সায়েদাবাদ বাসটার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন রুটের বাস ছেড়ে যায়। বাস ছাড়ার আগে চাঁদাবাজরা ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন। চাঁদার টাকা পরিশোধ না হলে বাস ছাড়তে দেওয়া হয় না। বাসচালকদের অভিযোগ, করোনার কারণে এমনিতেই বাসের যাত্রী কম। সিট পূর্ণ না হওয়ায় আগের মতো আয় নেই। তারপরও চাঁদা ছাড়া বাস চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা ভোরের পাতাকে বলেন, ক’মাস চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। এখন চাঁদাবাজরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিকভাবে ক’জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালেও চাঁদাবাজরা এখনও সক্রিয়া। রাজধানীতে চলাচলরত বাস ও মিনিবাস থেকেও এখন চাঁদা তোলা হচ্ছে। একাধিক বাসচালক ভোরের পাতাকে বলেন, ‘চাঁদা না দিলে কন্ট্রাকটর ও হেলপারকে মারধর করা হচ্ছে। পুরানো চাঁদাবাজদের সঙ্গে নতুন নতুন চাঁদাবাজদের চেহারা দেখা যাচ্ছে।’ শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, রাজধানীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫ হাজার গণপরিবহন চলাচল করছে। এসব বাস থেকে মাসে প্রায় ৬ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। সব টার্মিনালেই এখন চাঁদাবাজরা সক্রিয় রয়েছে। সমিতির কাছেও নালিশ দিয়ে লাভ হচ্ছে না। বাস টার্মিনালগুলো সিটি করপোরেশনের অধীনে। কিন্তু সিটি করপোরেশনও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। টার্মিনাল এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারাও চাঁদাবাজির বিষয়ে অবগত। কিন্তু তারাও নীরব।
তবে এইসব অভিযোগের বিষয়ে ভোরের পাতার সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এবং ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি আমাদের কাম্য না। এখন রাস্তাঘাটে কোনো চাঁদাবাজি হচ্ছে না। কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবেও না। চাঁদাবাজি বন্ধে আমাদের টিম কাজ করছে। তবে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়, এমন কিছু লোক চাঁদাবাজির চেষ্টা করছে। তারা কেউ আমাদের সংগঠনের লোক না। যদি আমাদের কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযোগের বিষয়ে ভোরের পাতাকে একাধিক ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন করে আবারো যারা চাঁদাবাজিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তাদের খুঁজতে মাঠে কাজ করছে পুলিশ বাহিনী।’ এক ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা গুলিস্থানে কর্মরত নাম প্রকাশ না করা শর্তে ভোরের পাতাকে বলেন, ‘গুলিস্থানে এবং ফুলবাড়িয়া এলাকায় ক’জন চাঁদাবাজরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের ধরার জন্য খুব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুনবেন যেকোন সময় ধরা পড়েছে তারা’
উল্লেখ্য, পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে গত ২৯ মে আইজিপির সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আইজিপি চাঁদাবাজি বন্ধে অভিযান চালানোর কথা বলেন। বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে চাঁদাবাজি বন্ধের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এরপর গত ১ জুন থেকে অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে প্রায় দেড় শতাধিক চাঁদাবাজকে পুলিশ গ্রেফতার করলে চাঁদাবাজি অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়।