রাজধানীর হাতিরঝিলের লেকের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আজিজুল ইসলাম মেহেদীর লাশের কাছে পড়ে থাকা এক টুকরো কাগজে একটি নম্বর লেখা ছিল। সেই নম্বরের সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হলো।
পাসপোর্টের টাকার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন করা হয়েছে চট্টগ্রামের তরুণ মেহেদীকে। আলাউদ্দিন, তামিম ও রহিম নামের তিনজনের সাহায্যে মেহেদীর বাল্যবন্ধু আহসান উল্লাহ তাকে খুন করেন। বুধবার এ চারজনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ এসব তথ্য জানায়।
নিহত মেহেদী আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। চাকরির ভাইভা ও পাসপোর্ট-সংক্রান্ত ঝামেলা মেটাতে শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বন্ধু আহসানের বাসায় উঠেছিলেন। মেহেদী গত বছর স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় গিয়েছিলেন। তার বাবা ফখরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। গত সোমবার সকালে হাতিরঝিল থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তার আহসান গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে এক্সিকিউটিভ শেফ এবং তামিম একই রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে কর্মরত। দুইজন খিলক্ষেতে একই বাসায় থাকেন। আহসানের আত্মীয় আলাউদ্দিন পেশায় পুরোনো গাড়ির ব্যবসায়ী হলেও মূলত পাসপোর্ট অফিসের দালাল। রহিম আলাউদ্দিনের মাইক্রোবাসের চালক। বুধবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে মূল হোতা আহসান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। অপর তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশীদ জানান, মেহেদী হত্যার ঘটনাটি ক্লু-লেস ছিল। পুলিশ মাত্র দুইদিনের ভেতর চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
হাতিরঝিল থানা পুলিশ জানায়, মেহেদী তিনটি পাসপোর্টের নাম সংশোধন করতে আলাউদ্দিন ও আহসানকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা দেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্টগুলো দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা দিতে পারেননি। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে মেহেদীর বিরোধ তৈরি হয়। আহসানকে টাকা ও পাসপোর্ট ফেরত দিতে চাপ দেন মেহেদী। নইলে তার কর্মস্থলে ও পুলিশের কাছে বিষয়টি জানাবেন বলেও হুঁশিয়ার করেন। একপর্যায়ে মেহেদীকে খুনের পরিকল্পনা করেন আহসান ও আলাউদ্দিন।
আহসান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, মেহেদী শনিবার রাত ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছে তার খিলক্ষেতের বাসায় গেলে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বিছানার চাদর, মশারি ও পলিথিনে মোড়ানো হয়। তখন আকস্মিকভাবে পাশের কক্ষ থেকে তামিম তার কক্ষে এসে ঘটনাটি দেখে ফেলেন। দুইজনই ফেঁসে যাবে- এমন ভয়ে তামিমও তাকে সহায়তা করেন।
আহসান আরো জানান, পরিকল্পনা করে আলাউদ্দিন জরুরি কাজের কথা বলে সিলেটে চলে যান। তবে হত্যার পর তাকে ফোনে ঘটনা জানানো হয়। এরপর লাশ গুম করতে রোববার ভোরে আলাউদ্দিন একটি গাড়ি পাঠান। লাশের পুঁটলি গাড়িতে তোলার সময়ে চালক তাতে কী আছে, দেখতে চান। ধরা পড়ার ভয়ে পুঁটলি খুলতে না চাইলে চালক চলে যান। তখন সকাল হয়ে যাওয়ায় মেহেদীর লাশের পুঁটলি আবার বাসায় নিয়ে খাটের নিচে রেখে দেন। এরপর তারা দুইজনই গুলশানে রেস্টুরেন্টে কাজে চলে যান। ওই দিন গভীর রাতে আলাউদ্দিন আবার মাইক্রো পাঠান। সোমবার ভোর ৪টার দিকে তারা সেই মাইক্রোবাসে তুলে হাতিরঝিলের নির্জন জায়গায় লাশের পুঁটলি ফেলে রেখে যান।
পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, হত্যাকারীরা মেহেদীর লাশটি প্রথমে সড়কে ফেলে দিতে চেয়েছিল। যাতে তার স্বজনরা ভাবতে থাকেন ছিনতাইকারীদের হাতে সে খুন হয়েছে। পরে সিদ্ধান্ত বদল হয়। এরপর একটি কাগজে মেহেদীর ফোন নম্বর লিখে তার ফোনসেটের সঙ্গেই রেখে দেয়।
আহসান পরিকল্পনা করেছিলেন, কোনো পথচারীর মোবাইল ফোন থেকে ওই নম্বরে ফোন দেবেন, যাতে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে চলে যায় এবং তারা আড়ালে থেকে যান। কিন্তু লাশটি হাতিরঝিলে ফেলার সময়ে চালক রহিম তাড়াহুড়া করতে থাকলে আহসান মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে ফোনসেটটি ছুড়ে মারেন। সেটি লেকের পানিতে পড়ে গেলেও কাগজটি উড়ে লেকের পাড়ে গিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ওই কাগজের ফোন নম্বরের সূত্র ধরেই মেহেদীর পরিচয় আর খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
হাফিজ আল ফারুক বলেন, আহসান ও আলাউদ্দিন ধরা পড়া এড়াতে নানা ফন্দি এঁটেছিল। যাতে মেহেদীর লাশ কেউ চিনতে না পারে, তার পরিচয় যাতে শনাক্ত না হয়- সে জন্য সব ব্যবস্থাই করেছিল। খুনের পর মোমের আগুনে মেহেদীর মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে যাতে পরিচয় শনাক্ত না হয়, সে জন্য মেহেদীর হাতের আঙুলগুলো বিকৃত করে দেয়া হয়েছিল।
ভোরের পাতা/এএম