আমরা কমবেশি সবাই টাইগার বা বাঘ এবং লায়ন বা সিংহ সম্পর্কে জানলেও লাইগার নিয়ে আমাদের জানাশোনা একেবারে কম।
লাইগার হলো মূলত পুরুষ সিংহ এবং স্ত্রী বাঘের সংকরায়নের ফলে জন্ম নেওয়া নতুন এক হাইব্রিড প্রাণী।এটি দেখতে বৃহৎ আকৃতির সিংহের মতো হলেও এর গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।মজার বিষয় হলো সিংহ সাঁতার কাটতে না জানলেও কিন্তু লাইগার বাঘের মতো সাঁতার কাটতে সক্ষম।
লাইগারের প্রকারভেদ:শারীরিক আকার আকৃতির উপর ভিত্তি করে লাইগার কে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।এরা হলো:কেশরযুক্ত লাইগার,কেশরবিহীন লাইগার,টাইগার লুক-এ্যা লাইক লাইগার,এবং সাদা লাইগার।(বলে রাখা ভালো,শারীরিক এসব ভিন্নতা শুধুমাত্র পুরুষ লাইগার এর মধ্যেই দেখা যায়)।এর মধ্যে প্রথম দুটি সাধারণ হলেও সাদা লাইগার কিন্তু সচরাচর দেখা যায়না।সবগুলো লাইগার এর মধ্যে মেইনড লাইগার বা কেশরযুক্ত লাইগার এর ঘাড়ে সিংহের মতো কেশর থাকে।এই লাইগার এর কেশরগুলো সিংহের তুলনায় ছোট হয় এবং এরা দেখতে স্বর্ণকেশী ও হয়ে থাকে।অপরদিকে মেইনডলেস বা কেশরবিহীন লাইগারের ঘাড়ে কোন কেশর থাকেনা বলে এদের কেশরবিহীন লাইগার বলে।হারকিউলাস,জিওস,ভলকান এবং সিনবাদ হলো কয়েকটা কেশরবিহীন লাইগার এর উদাহরণ।এর মধ্যে হারকিউলাস হলো সবচেয়ে বড় লাইগার যার ওজন হলো প্রায় ৯২১ পাউন্ড এর মতো। টাইগার লুক-এ্যা লাইক লাইগার দেখতে প্রধানত বাঘের মতো।এদের শরীরে মূলত সিংহের তুলনায় বাঘের জিন বেশি থাকে বলে এমনটা দেখায়।কিলার রকি লাইগার হলো টাইগার লুক-এ্যা লাইক লাইগার এর মধ্যে অন্যতম।অপরদিকে সাদা লাইগার এর উৎপত্তি হলো সাদা পুরুষ সিংহ ও সাদা স্ত্রী বাঘ হতে। অবাক করা তথ্য হলো যে, পৃথিবীতে মাত্র ৪ টি সাদা লাইগার রয়েছে।উপরোক্ত এই ৪ রকমের লাইগার ছাড়াও আরো দুই রকম লাইগার পাওয়া যায় এরা হলো:লিলিগার এবং টিলিগার।
আকার আকৃতি:বিশুদ্ধ প্রজাতি হিসেবে সাইবেরিয়ান বাঘকে বিড়াল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতি হিসেবে ধরা হলেও কিন্তু লাইগার হলো বিড়াল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী।একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ লাইগার প্রায় ৩.৩ মিটার বা ১০.৮ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে।বয়সভেদে এদের ওজন ৪০০কেজি বা ৯০০ পাউন্ড হয়ে থাকে।তবে কারো কারো দেওয়া তথ্যমতে,এরা ১০০০কেজি বা এক মেট্রিকটন পর্যন্ত ও হয়ে থাকে।বিজ্ঞানীদের মতে পুরুষ সিংহের শরীরে বিশেষ ধরনের এক গ্রোথ প্রোমোটিং জিন থাকে যা বাঘের শরীরে অনুপস্থিত থাকে ফলে লাইগার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়তেই থাকে।
স্বভাব ও বাসস্থান:বাঘ ও সিংহ ভয়ংকর শিকারি হওয়া সত্ত্বেও এরা নিরীহ হয়ে থাকে।লাইগার মানুষের সান্নিধ্য পেতে পছন্দ করে। এই স্বভাব তারা পুরুষ সিংহের কাছে থেকে পায় বলে ধারনা করা হয়।লাইগার মূলত মানুষের সাথে খেলতে পছন্দ করে এবং এরা খুব সামাজিক হয়। যে কেউ চাইলে একটি লাইগারকে পোষ মানাতে পারে।।লাইগার মূলত বাঘ এবং সিংহের মতো গর্জন করে থাকে। তবে সিংহের মতো গর্জন বেশি করে থাকে।এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং পানিতে খেলতেও পছন্দ করে।যেহেতু লাইগার প্রাকৃতিক ভাবে হয় না তাই এদের বনে পাওয়া যায়না।বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাইগার কে চিড়িয়াখানা,অভয়ারণ্য এবং মানুষের কাছে দেখা যায়।এদের এই শান্ত স্বভাবের কারনে অনেকে পোষ মানিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়।
খাদ্যাভাস:অন্যসব বিড়ালজাতীয় প্রাণীর মতো লাইগার ও মাংসাশী প্রাণী।এরা মূলত অন্য প্রাণীদের মাংস খায় এবং এর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি পেয়ে থাকে।একটি পূর্ণবয়স্ক বিশালদেহি লাইগার দৈনিক গড়ে ৩০ পাউন্ডের মতো কাঁচা মাংস খেতে পারে।তবে ডঃএন্টল এর দেওয়া এক তথ্যমতে,কিছুকিছু ক্ষেত্রে এরা ১০০ পাউন্ড পর্যন্ত খেতে সক্ষম।এদের খাদ্যতালিকায় মূলত গরুর মাংস থাকলেও এরা হরিণের মাংস বা হরিণ বিশেষ এর মাংস ক্ষেতে পছন্দ করে।তবে কোন কোন লাইগার মুরগীর মাংস ও খেয়ে থাকে।প্রতিটি প্রাণীর জন্য পানির প্রয়োজন হলেও একটি লাইগার গড়ে প্রতিদিন ৪লিটার এর মতো পানি পান করে থাকে।এরা যদি বন্য পরিবেশে থাকতো তাহলে এদের খাদ্যতালিকায় স্থান পেতো শূকর,বন্যশূকর,বন্যমহিষ এর মাংস,হরিণ,শিয়াল আরো কত কি!
খাবার কৌশল:এরা মূলত এদের শক্তিশালী দেহ এবং থাবার মাধ্যমে শিকার ধরে থাকে।এদের একটি কামড়ের শক্তি প্রায় ৯০০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে।এদের রয়েছে বিশালাকৃতির শক্ত চোয়াল এবং তীক্ষ্ণ দাঁত যা দিয়ে এরা মাংস ছিঁড়ে খায়।
প্রজনন:অনেকের মতে লাইগার হাইব্রিড প্রাণী হওয়ায় এটি বংশবিস্তার করতে পারেনা।কিন্তু ধারণাটি পুরোপুরি মিথ্যা।লাইগার এর উর্বরতা কম কিন্তু ব্রিড করতে সক্ষম(উল্লেখ্য পুরুষ লাইগার একেবারে অনুর্বর)।মূলত স্ত্রী লাইগার পুরুষ সিংহ বা পুরুষ বাঘের সাথে ব্রিড করতে সক্ষম।এটি পুরুষ বাঘের সাথে ব্রিড করলে টিলিগার উৎপন্ন হয়।অন্যদিকে পুরুষ সিংহের সাথে ব্রিড করলে উৎপন্ন হয় লিলিগার।
লাইগার এর সংখ্যা:২০২০ সালের বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণী অভয়ারণ্য,সাফারি পার্ক,চিড়িয়াখানা ইত্যাদিতে প্রায় ১০০টির ও বেশি লাইগার রয়েছে।এর মধ্যে শুধুমাত্র আমেরিকা,চীন এবং রাশিয়া এই ৩ টি দেশেই রয়েছে ৮০% এর বেশি লাইগার।সবচেয়ে বেশি লাইগার আমেরিকার প্রায় ১৩ টি রাজ্যের ২৪-২৮টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে যার সংখ্যা ৫০টির ও বেশি।তার মধ্যে শুধুমাত্র ফ্লোরিডা তে রয়েছে সবচেয়ে বেশি ১২ টি লাইগার।অপরদিকে,চীনের ৮টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে ২৪টি লাইগার আর রাশিয়ার ৭টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে প্রায় ১২ টি লাইগার।এই ৩ টি দেশ ছাড়াও আরো ১০টি দেশে লাইগার রয়েছে বলে জানা যায়।দেশগুলো হলো:থাইল্যান্ড(১০টি),আর্জেন্টিনা(৪টি),মেক্সিকো(৩টি),ইতালি(২টি),সংযুক্ত আরব আমিরাত(২টি),ফিলিপাইন্স (২টি),দক্ষিণ আফ্রিকা(১টি),ইন্দোনেশিয়া(১টি),তাইওয়ান(১টি),দক্ষিণ কোরিয়া(১টি)।অন্যদিকে,ভারত,ইংল্যান্ড,জার্মানি,জাপান,লিবিয়া ও নেদারল্যান্ডে আগে লাইগার থাকলেও বর্তমানে তা লাইগার শূন্য বলে জানা গেছে।লাইগার
বাণিজ্য:বর্তমানে মানুষের লাইগার সম্পর্কে জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে লাইগার বাণিজ্য।অন্যদিকে এটিকে বাচ্চা অবস্থায় পোষ মানানো অনেক সহজ এবং লাইগার খুব সামাজিক হওয়ায় একইসাথে এটি বিরল হাইব্রিড প্রাণী হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। ফলে দিন দিন বাণিজ্য বেড়েই চলেছে।আমেরিকা তে লাইগার ও অন্যান্য বিড়াল প্রজাতি বেশি থাকায় এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এর ব্যবসা হয়ে থাকে যা পুরোপুরি অবৈধ।বর্তমানে লাইগার কে ঘিরে শুরু হয়েছে কালোবাজারি।প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায় গোপনে গোপনে গাড়িতে করে লাইগার বিক্রি করার জন্য নিয়ে যেতে।গোপনে গোপনে এইভাবে লাইগার পরিবহন করতে করতে কিছু লাইগার মারা ও যায়।টাকার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লাইগার নামক এই বিরল হাইব্রিড প্রাণীকে তাদের অভয়ারণ্য হতে মানুষের কাছে বিক্রি করছে।
সংরক্ষণ:যেহেতু লাইগার প্রাকৃতিকভাবে হয় না এবং বন্য পরিবেশে থাকেনা তাই এদের সংরক্ষণ করার কোন নির্দিষ্ট উপায় নেই।তবে লাইগার রক্ষার্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো লাইগার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এবং অসাধু চক্রের হাত থেকে লাইগার কে রক্ষা করে এদের অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিতে হবে।
লিখেছেন : ফারেশ হোসেন(পাইলট)
ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়