মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে বড় ইস্যুগুলো অবশ্যই করোনাভাইরাস মহামারি, সুপ্রিম কোর্ট এবং পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার। কিন্তু এর বাইরে লক্ষ লক্ষ আমেরিকান কথা বলছেন আরো বিচিত্র এবং উদ্ভট এক বিষয় নিয়ে। ব্যাপারটা ছড়াচ্ছে ইন্সটাগ্রামের মত সামাজিক মাধ্যমে। এটি একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব - যাকে বলা হয় কিউএ্যানন। খবর- বিবিসি
এর মূল কথাটা হলো: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক গোপন যুদ্ধ চালাচ্ছেন। যুদ্ধটা মার্কিন সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংবাদ মাধ্যমের জগতের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু লোকের বিরুদ্ধে। এই লোকেরা এলিট শ্রেণীর- তারা শয়তানের উপাসক এবং পিডোফাইল, অর্থাৎ শিশুকামী।
এটাই মূল গল্প, তবে এর বহু শাখাপ্রশাখা রয়েছে এবং এর সাথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গল্প যোগ হচ্ছে। এসব উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে হাজার হাজার লোক। তারা মনে করেন একদিন হিলারি ক্লিনটনের মত কিছু বিখ্যাত লোককে এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
হিউস্টনের বাসিন্দা ২৪ বছরের জেড ফ্লুরি। সম্প্রতি তার বন্ধুদের সাথে এসএমএসে আলাপ হয় এ বিষয়ে যে- ডেমোক্রেটিক পার্টির এলিটরা শিশু পাচারের একটা চক্র পরিচালনা করছেন। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে শিশু নিপীড়নের অভিযোগ।
জেড এসব মিথ্যে দাবির পাল্টা জবাব দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকদের মধ্যে এগুলো দাবানলের মত ছড়াচ্ছে। হিউস্টন থেকে ১ হাজার মাইল দূরে ফ্লোরিডায় থাকেন টম লং। তিনি ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন না, তবে তার ফেসবুক ফিড এখন সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বে।
বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হচ্ছে- ওই সব শিশু পাচারকারীদের হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প। টম লং বলেন, 'এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা, কিন্তু তা ছড়াচ্ছে তো ছড়াচ্ছেই'।
অবশ্য বলা দরকার যে ট্রাম্পের বিরোধীদের মধ্যে থেকেও যে ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব একেবারে ছড়াচ্ছে না তা নয়। জো বাইডেন সমর্থকদের একটি গোষ্ঠী সম্প্রতি গুজব ছড়ায় যে ট্রাম্পের করোনাভাইরাস পজিটিভ হবার খবর আসলে ভুয়া।
কিউএ্যানন হচ্ছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিবিসির গবেষণায় দেখা গেছে, এ নিয়ে মন্তব্য, শেয়ার এবং লাইক হয়েছে ১০ কোটিরও বেশি। ফেসবুকে সবচেয়ে বড় কিউএ্যানন গ্রুপটির লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের সংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখ। তুলনা করে দেখা যায়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের মতো বিশ্বব্যাপি সাড়া তোলা আন্দোলনের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে - কিউএ্যাননের প্রতিক্রিয়া তার প্রায় দু-তৃতীয়াংশ।
সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলো শুরুতে এটা ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সমর্থকরা নানা কৌশলে, নতুন নতুন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে আবার ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর টুইটারের সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কিউএ্যাননের কট্টর সমর্থকরা এখনো একটা প্রান্তিক গোষ্ঠী বলা যায়।
সেপ্টেম্বর মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়- অর্ধেক আমেরিকানই এদের নাম শোনেনি। কিন্তু তা হলেও এটা ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে পৌঁছে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পটভূমিতে মানুষের মনের অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে এসব তত্ত্ব ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুইটনি ফিলিপস বলছেন, খুব কম আমেরিকানই বিশ্বাস করে যে শয়তানের উপাসক এলিটরা শিশু নিপীড়নের চক্র চালাচ্ছে - তবে কিউএ্যাননের অন্য নানা গুজব কিন্তু মানুষের মনে জায়গা করে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'এর মধ্যে একটা হলো ডিপ স্টেট - সরকারের মধ্যে লুকানো আরেকটি সরকার - যারা ট্রাম্পকে হেয় করার চেষ্টা করছে। কিউএ্যানন এ ধারণা সৃষ্টি করেনি, কিন্তু এটা ছড়ানোয় বড় ভুমিকা রেখেছে।।
জেড ফ্লুরি তার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখেছেন, তাদের কেউ কেউ এখন মনে করছেন ডেমোক্রেটরা একটা অশুভ শক্তি, এবং ট্রাম্প হচ্ছেন একজন ত্রাতা। তিনি উদ্বিগ্ন যে এটা হয়তো তাদের ভোটের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। হুইটনি ফিলিপস মনে করেন, কিউএ্যাননের আসল বিপদটা হলো - এতে গণতন্ত্র জিনিসটাকেই প্রত্যাখ্যান করার একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
ফেসবুক সহ সামাজিক মাধ্যমগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে এ ব্যাপারে। তারা বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ, একাউন্ট বা পোস্ট নিষিদ্ধ করছে, বিধিনিষেধ আরোপ করছে। কিন্তু তার পরও নানা উপায়ে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের ফিরে আসতে দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে।
তবে ফেসবুক এখন কিউএ্যাননেন সকল একাউন্ট, পেজ ও গ্রুপ নিষিদ্ধ করেছে। তবে এসব পদক্ষেপ কিউএ্যাননের জনপ্রিয়তার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা তা কেউ বরতে পারে না। টম লং অবশ্য মনে করেন ক্ষতি যা হবার তা এর মধ্যেই হয়ে গেছে। যে দেশে তিনি বড় হয়েছেন - সে দেশ এখন তার কাছেই যেন অচেনা হয়ে গেছে।
/ই