মানুষ দুনিয়াতে চিরস্থায়ী নয়। তেমনিভাবে যে দুনিয়াতে মানুষ বসবাস করছে তাও চিরস্থায়ী নয়। ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একদিন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কিয়ামত সংঘটিত হবে। এটাই মুসলমানের আকিদা।
দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগে অনেক আলামত দেখা দেবে। যা দ্বারা বুঝা যাবে দুনিয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। রাসূল (সা.) এর হাদিসে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হাদিসের এই অধ্যায়কে নামকরণ করা হয়েছে ‘ফিতান’ দ্বারা।
‘ফিতান’ শব্দটি ‘ফিতনা’ এর বহু বচন। অর্থ হচ্ছে, পরীক্ষা করা। যেহেতু ওইসব বিষয় হচ্ছে মুসলমানের ঈমান পরীক্ষার মাধ্যম, তাই উক্ত শব্দ দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে।
ফেতনার যুগে মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হবে। হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) সূত্রে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, কেয়ামতের আগে ফেতনা প্রকাশ পাবে। ফেতনা হবে অন্ধকার রাতের মতো। এক লোক সকালে মুমিন থেকে সন্ধ্যা আসার সঙ্গে সঙ্গে কাফের হয়ে যাবে। সন্ধায় মুমিন তো সকালে কাফের হয়ে যাবে।
ওই ফেতনার সময়ে যে লোক বসে থাকবে, সে উত্তম ওই ব্যক্তি থেকে যে দাঁড়িয়ে আছে। তদ্রুপ দ্রুত গতিতে চলমান ব্যক্তির চেয়ে ধীরগতিতে চলমান ব্যক্তি উত্তম হবে। ওই সময় তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, ধনুক ভেঙ্গে ফেলা। পাথরে আঘাত করে তরবারির ধার নষ্ট করে ফেলা। ওই সময়ে তোমাদের ওপর কেউ যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে তোমরা আদমের দুই সন্তানের মধ্য থেকে উত্তম সন্তানের মতো হও।
অন্যএক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম তখন জিজ্ঞেস করেন, ওই সময় আমাদের করণীয় কি? রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা ঘরে সময় পার করবে। চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করবে। (মেশতাক, হাদিস নম্বর: ৫৩৯৯)।
রাসূল (সা.) কেয়ামতের আগে সংঘটিত ফেতনাকে অন্ধকার রাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্ধকার রাতে যেমন সবকিছু অস্পষ্ট থাকে তদ্রুপ ওই সময়েও সবকিছু অস্পষ্ট থাকবে।
সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিল চিনা যাবে না। অন্ধকার যেমন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তদ্রুপ ফেতনাও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।
কোনো ব্যক্তি বা এলাকা তা থেকে রেহাই পাবে না। তা থেকে বেঁচে থাকতে হলে রাসূল (সা.) এর নির্দেশ হচ্ছে, ঘরে থাকা এবং চুপ থাকা। এর সমর্থনে হজরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকেও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম একদিন রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, কেয়ামতের কঠিন মুহূর্তে বাঁচতে হলে আমাদের কোন আমল করতে হবে?
রাসূল (সা.) বলেন, তিনটি আমল করতে হবে। এক. তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়। দুই. অতীতের গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করো। তিন. নিজের জবানকে নিয়ন্ত্রণ করো। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ২৪০৬)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর একটি প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, ‘মানুষের মাঝে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোক হচ্ছে সে, যে নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যকে নিয়ে কথা বলে। তার চেয়েও বড় ক্ষতিগ্রস্ত হলো ওই লোক, যে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় আল্লাহকে ভুলে।’ তাই সর্ব যুগেই মানুষের হেফাজত ও সম্মান বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে, কম কথা বলা। কাউকে নিয়ে কিছু বলার আগে নিজের সংশোধনের চিন্তা করা।
কেয়ামতের আগে যত ফেতনা হবে, ভয়াবহতার দিক থেকে অন্যতম হচ্ছে দাজ্জালের ফেতনা। সাহাবায়ে কেরাম একদিন কেয়ামত প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছো? সাহাবায়ে কেরাম বলেন, কেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। তখন রাসূল (সা.) বলেন, কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দশটি আলামত প্রকাশ পায়। এর একটি হচ্ছে দাজ্জালের আবির্ভাব।’ (মেশকাত, হাদিস নম্বর: ৫৪৬৪)।
দাজ্জালের ভয়বহতা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘হজরত আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো দাজ্জালের ফেতনা।’ (মেশকাত, হাদিস নম্বর:৫৪৬৯)।
ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) এর সূত্রে হাদিসটি সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে। অন্য এক হাদিসে এসেছে, দুনিয়াতে যত নবী এসেছেন, সবাই স্বীয় উম্মতকে দাজ্জালের ফেতনা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। (মেশকাত, হাদিস নম্বর: ৫৪৭১)।
দাজ্জালের বিভিন্ন আলামত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেন উম্মত সহজে তাকে চিনতে পারে। নবী করিম (সা.) এর সময়ে মদিনায় একটি শিশু জন্ম নেয়। তার নাম ছিলো ইবনে সায়্যাদ। আচরণ ও শারীরিক দিক থেকে দাজ্জালের সঙ্গে তার মিল ছিলো।
নবী করিম (সা.) তার কাছে যেতেন। উদ্দেশ্য তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। একদিন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি একথার সাক্ষ্য দাও যে, আমি আল্লাহর রাসূল? তখন সে বাঁকা উত্তর দেয় এভাবে যে, আমি সাক্ষ্য দেই তুমি উম্মিদের (অশিক্ষিত) রাসূল।
তখন সে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে যে, তুমি কি সাক্ষ্য দাও আমি আল্লাহর রাসূল? রাসূল (সা.) তখন তাকে ধরে জোরে চাপ দিলেন এবং বলেন, আমি ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং নবীদের ওপর।’ (মেশকাত, হাদিস নম্বর: ৫৪৯৪)।
ইবনে সায়্যাদের মাঝে দাজ্জালের বিভিন্ন আলামত থাকায় সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে অনেকে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বিশেষভাবে হজরত ওমর (রা.)। কিন্তু রাসূল (সা.) একথা দিয়ে ফিরিয়ে আনেন যে, যদি সে দাজ্জাল হয় তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করতে পারবে না। আর যদি দাজ্জাল না হয় তাহলে তাকে হত্যা করার কোনো অর্থ হয় না।
দাজ্জালের ফেতনা যত ভয়াবহ। তা থেকে নিজেকে রক্ষা করাও অনেক কঠিন। রাসূল (সা.) বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় সে জান্নাত এবং জাহান্নামের সাদৃশ্য বস্তু নিয়ে ঘোরাফেরা করবে। যারা তার প্রতি ঈমান আনবে তাকে সে জান্নাতে ঢুকাবে। যারা আনবে না তাকে জাহান্নামে দেবে। তবে তার জান্নাত হচ্ছে জাহান্নাম আর জাহান্নাম হচ্ছে জান্নাত। সে মৃত মানুষকে জীবিত করে দেখাবে। তারপরও আমলদার খাঁটি মুমিনরা নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
সূরা কাহাফের প্রথম তিন বা দশ আয়াত মুখস্থ করার ফজিলত:
রাসূল (সা.) একদিন দাজ্জালের বর্ণনা দিলেন। তা শুনে সাহাবায়ে কেরাম ভয় পেলেন। তখন ছিলো সকালবেলা। বিষয়টি তাদের মনে এতবেশি ভয়ের সঞ্চার করে যে, মনে করতে লাগলেন দাজ্জাল বুঝি খেজুর বাগানের পাশেই এসে গেছে।
সন্ধাবেলায় যখন তারা রাসূল (সা.) এর দরবারে গেলেন, তাদের চেহারা দেখে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। তখন রাসূল (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল ভিন্ন অন্য একটি বিষয়কে আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাচ্ছি। আমি থাকতেই যদি ওর আবির্ভাব ঘটে তাহলে আমি নিজেই তোমাদের থেকে তাকে ফেরাবো। আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর যদি সে বের হয় তাহলে প্রত্যেকে নিজের ব্যাপারে সংরক্ষণকারী হবে।’
এরপর নবী করিম (সা.) দাজ্জালের কিছু বিবরণ দেন। এবং তারপর বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে কেউ দাজ্জালের সাক্ষাত পেলে সে যেন সূরা কাহাফের প্রথম অংশ তার সামনে তেলাওয়াত করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৭৩৩৩)।
পথভ্রষ্ট আমির-উমারা দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর:
রাসূল (সা.) দাজ্জালের চেয়ে বেশি উম্মতের জন্য ভয় করেছেন একটি বিষয়কে। মুহাদ্দিসরা বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সরল ও ইনসাফের পথ থেকে বিচ্যুত আমিরা। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৮৮)।
এ ব্যাপারে আরো বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন: হজরত ইবনে লাহিয়ার সূত্রে হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূল (সা.) এর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। তখন রাসূল (সা.) বলেন, দাজ্জালকে ছাড়া অন্য একটি বিষয়কে আমি উম্মতের ব্যাপারে বেশি ভয় পাচ্ছি। রাসূল (সা.) তিনবার কথাটি বলেন।
হজরত আবু জর (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে তখন প্রশ্ন করি, দাজ্জালের চেয়ে বেশি আপনি কাকে ভয় পাচ্ছেন? হুজুর (সা.) বলেন, ‘গোমরা ঈমামদেরকে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর: ২১১৯৩)।
বর্ণনাকারী ইবনে লাহিয়া হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল বলে মুহাদ্দিসরা মত দিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে আরো বহু বর্ণনাকারী হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাই এতে কোনো সমস্যা নেই। যেমন: হজরত ছাওবান (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উম্মতের ব্যাপারে আমার ভয়ের কারণ হচ্ছে পথভ্রষ্ট ইমামগণ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ২২২৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪২৫২)।
পথভ্রষ্ট ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, অনুকরণীয় ব্যক্তিবর্গ, যারা মানুষদেরকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে। এর মাঝে তিন শ্রেণির লোক অন্তর্ভূক্ত। এক. পাপাচারে লিপ্ত শাসক শ্রেণি। দুই. শরীয়তের হুকুম অমান্যকারী আলেমরা। তিন. জাহেল ইবাদতগুজার বান্দা।
এই তিন শ্রেণিকে রাসূল (সা.) উম্মতের জন্য দাজ্জালের চেয়ে বেশি ভয় পেতেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) গোমরা ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন, আমির- উমারা। (মাজমুআতুল ফাতওয়া লিইবনে তাইমিয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৫৫)।
রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে, প্রখ্যাত বুজুর্গ ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (রাহ.) বলতেন, আমার যদি এমন দোয়ার তাওফিক হতো যে, তা আল্লাহ কবুল করবেনই; তাহলে আমি ইমাম তথা আমির-উমারাদের জন্য ওই দোয়া করতাম।
একজন প্রশ্নকারী প্রশ্ন করলেন, কেন আপনি এমন করতেন? তিনি বলেন, ইমামের সংশোধন দ্বারা জাতি ও দেশের সংশোধনের রাস্তা খুলে যায়। তাই আমি তার জন্যই ওই দোয়াটি করতাম। এরপর তিনি রাষ্ট্র ও জাতির সংশোধন কীভাবে হবে তার ব্যাখ্যা দেন।’ (জামিউল ইলম, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৪১)।
আজকে দাজ্জালের ফেতনার আশঙ্কায় আমরা অনেক আমল করছি। উম্মতের জন্য দাজ্জালের ফেতনা একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখনো তা প্রকাশ পায়নি। কিন্তু নবী করিম (সা.) যে ফেতনাকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়াবহ আখ্যা দিয়েছেন এখন তা আমাদের মাঝে চলছে। কিন্তু আমরা কি তার মোকাবিলা করার কোনো ফিকির করছি?
ভোরের পাতা/এএম