#দেশের প্রতিটি জেলায় ডিএনএ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে: আবদুল মতিন খসরু।
#আদালতে ধর্ষিতাকে স্পর্শকাতর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না: শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
#ধর্ষণ প্রতিরোধে পাড়া মহল্লায় কমিটি করতে হবে: মেহের আফরোজ চুমকি।
#ক্ষতিপূরণের অর্থ ধর্ষিতাকে দিতে হবে: নূরজাহান বেগম মুক্তা।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রীয় মদদে শুধু নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু, মুসলিম, বৃদ্ধা, শিশুদেরও ধর্ষণ করেছিল, কখনোই তারা এ ধর্ষণের বিচার করেনি। এমনকি মামলাও করতে দেয়নি। এখন তারা ধর্ষণ ইস্যুতে রাজনীতি করছে। এই জঘন্য ও নিকৃষ্টতম অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার যখন উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তখন তারা প্রশংসা না করে, উল্টো সমালোচনা করছে। সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে সন্তানদের ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে, তাহলেই ধর্ষণ কমে আসবে মনে করেন আলোচকরা। দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১২২ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা।
শুক্রবার (০৯ অক্টোবর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাড. আবদুল মতিন খসরু, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু বিষয়ক সম্পাদক, সংসদ সদস্য এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ্যাড. মেহের আফরোজ চুমকি, সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এ্যাড. নূরজাহান বেগম মুক্তা। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
এ্যাড. আবদুল মতিন খসরু বলেন, কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে ধর্ষণের যেন মহামারি লেগে রয়েছে। এর কারণে সারা বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা কিছুটা নিচু হয়ে যাচ্ছে। যারা ধর্ষিত হচ্ছে, তারা তো আমাদেরই মা-বোন। এটা বন্ধের জন্য আমাদের অবস্থা বুঝে কিছু কাজ করতে হবে। আমাদের পরিবার, স্কুল-কলেজের সিলেবাস, আমাদের পরিবেশ এটা যাতে ধর্ষণের সহায়ক না হয় সেটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। দেশের অনেক জায়গায় ধর্ষণ হয় কিন্তু মামলা হয়না। যারা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণ হচ্ছে তারা অনেকেই এটা লুকিয়ে রাখে লোক সমাজের ভয়ে। ধর্ষিতার পিতা-মাতারা অনেক সময় এই সম্মানের ভয়ে মামলা করেনা। কারণ মামলা করতে গেলে সে আরেকবার ধর্ষণ পরিস্থিতির মত অবস্থার শিকার হয়। কারণ আমরা উকিলরা যেভাবে তাদের জেরা করি সেগুলো বলার মত ভাষা না। আমি আইনজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, ধর্ষিতারা কোর্টে এসে আরেকবার ধর্ষণের মত অবস্থার শিকার হয়; এই রকম একটা ভাব চলে আসছে অনেক দিন ধরেই। তাই আমাদের চিন্তা করা উচিৎ আমাদের ঘরেও মা-বোন আছে। আবার মামলার দীর্ঘতার জন্য অনেক পিতা-মাতারা মামলা করতে চায় না। আমাদের দেশে মাত্র দুটি ডিএনএ ল্যাবরেটরি আছে। এইসব ল্যাবরেটরিতে যেসব পরীক্ষা পড়ে রয়েছে তা নিস্পন্ন করতে আরও দুই-তিন বছর সময় লেগে যাবে। তাই দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে ডিএনএ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে। আমাদের নারীরা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। তাদের ইজ্জত যদি আমরা জাতিগতভাবে রক্ষা না করতে পারি তাহলে আমরা কিভাবে সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে উঠবো। এরপর মামলা দ্রুত নিষ্পন্নের জন্য প্রচুর বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে দেশে ধর্ষণের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রিয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন নারী নির্যাতন আইনের ৯ এর ১ ধারা পরিবর্তন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি বর্তমান সময়ের সবচে স্বাগত জানানোর মতো উদ্যোগ। আমি বিষয়টার মধ্যে রাজনীতি আনতে চাচ্ছি না। তারপরও বলতে হয়, ধর্ষণের মহামারী বিএনপি-জামায়াতের আমলেই শুরু হয়েছিল। ২০০১ সালের পূর্ণিমা শীলের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল রাষ্ট্রীয় মদদে। তখন মেয়েটি মামলাও করতে পারেনি। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কতজন নারী রাষ্ট্রীয় মদদে ধর্ষিত হয়েছে। বিচারহীনতার কারণেই অপরাধীরা আবারো অপকর্ম করার সুযোগ পায়। বিএনপি এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কাজও আটকে দিয়েছিল। সারা বাংলাদেশের মানুষকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন এমন একটি শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য। একই সঙ্গে আমি ধর্ষণ মামলার রায়ের হার মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ। এটিকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। একই সঙ্গে আইনমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করতে চাই, ধর্ষণ মামলার সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করতে হবে। কেননা, আদালতে জেরার সময় আরেকবার ধর্ষণ করা হয়। ব্যক্তিগত যৌন স্পর্শকাতর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। আমি মতিন খসরু ভাইয়ের সাথে একমত, প্রত্যেক জেলায় ডিএনএ টেস্ট করার কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে স্পেশাল ফোর্স দিয়ে ধর্ষণ মামলার তদন্ত করতে হবে।
মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, দৈনিক ভোরের পাতাকে প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটি সময়োপযোগী অনুষ্ঠানের আলোচনায় আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। এছাড়া আমি আমার পূর্ববর্তী দুই বক্তা আব্দুল মতিন খসরু ভাই এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভাইয়ের বক্তব্যের সাথে একমত হয়ে কিছু বলতে চাই। আজকে বাংলাদেশে যে পাশবিক ঘটনা ঘটছে তা সামাজিক অবক্ষয়। এটা কোনো রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। দেখুন, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাদ্রাসার শিক্ষক থেকে শিক্ষিত মানুষরাও এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা যাদের সভ্য বলি তারাও এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। শুধুমাত্র নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে হিন্দু পরিবারের ছোট ছোট নারীরাও রক্ষা পায়নি। দেখুন, আমাদের সরকার কাউকে রক্ষা করেনি। সবাইকে গ্রেপ্তার করছে। তারপরও একটা মহল সেটিকে সরকারের দিকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কাজ করে যাচ্ছেন, তাতে করে আমি শক্ত করে বলতে পারি ধর্ষকদের পক্ষে, নারীর প্রতি যারা অসম্মান করে তাদের পক্ষে তিনি নন। আমি আব্দুল মতিন খসরু ভাইকে আরো একবার ধন্যবাদ দিতে চাই, আইনমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমি পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ধর্ষণের বিচারের কথা উল্লেখ করতে চাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ ৩০ বছর কারাবাস, রাশিয়াতে ২০ বছর, চীনে মেডিকেল রিপোর্টে অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড, পোল্যান্ডে বুনো শুয়োরের খাচায় দিয়ে মৃত্যুদণ্ড, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পাথর ছুড়ে হত্যা, সৌদিতে শুক্রবার জুম্মার পর জনসম্মুখে শিরচ্ছেদ, আফগানিস্তানে ৪ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে পাড়ায় মহল্লায় প্রতিরোধ গঠন করে ধর্ষণ রোধ করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্নভাবে গড়ে তুলতে হবে।
নূরজাহান বেগম মুক্তা, আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন করোনা নামক একটা বৈশ্বিক মহামারী চলছে। যেকোনো মহামারীতে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশুরা। আজকের দিনে ধর্ষণের যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। তবে একই সঙ্গে আমি বিষয়টিকে রহস্যময়ও মনে হয়। আমি ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বলতে চাই, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে পেট্রোল বোমা, অগ্নি সন্ত্রাস চলেছে, এরপর দেখেছি বিদেশী কূটনীতিকদের হত্যা করতে, বিভিন্ন মার্কেটে অগ্নি উৎসব চলেছে। এসব ঘটনার পিছনে কোনো ঘটনা রয়েছে কিনা সেটাও আমাদের তদন্ত করে দেখতে হবে। আজকের দিনে সামাজিক অপরাধ ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু এখন আমরা সেগুলো বেশি বেশি জানতে পারছি। কারণ এখন প্রচারমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব কিছুই প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে পূর্ণিমা, নফুজা, রহিমাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল শুধুমাত্র নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিসংখ্যানের ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রদলের সীমান্ত, মিতুলরা ধর্ষণ করেছিল। দিনাজপুরের ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যার পর তার লাশের ওপর পা দিয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী চীনে গিয়েছিল বিশ্ব নারী সম্মেলনে যোগ দিতে। বিএনপি কখনোই এসব ধর্ষণ হত্যার বিচার করেনি। বরং বর্তমান সরকার বিচার করার জন্য উদ্যোগ নেয়ার পর প্রশংসা না করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। বিএনপি যখন ধর্ষণের বিচার চেয়ে কথা বলে তখন লজ্জা লাগে। এক সময় এসিড নিক্ষেপের কারণে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে অনেকাংশেই কমে এসেছে। এক্ষেত্রে ধর্ষণ অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পক্ষে আমি। কেননা, এই অপরাধী জেল থেকে কোনোভাবে আইনের ফাঁকফোকরের কারণে বের হতে পারলে সে আবারো একই অপরাধ করবে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে তার সামনে এই সুযোগ আর থাকবে না। একই সাথে আইনের কিছু ধারায় পরিবর্তন করতে হবে। একই সাথে নারী চিকিৎসক দিয়ে মেডিকেল চেক আপ করতে হবে। আইনে এখন অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। বিষয়টাকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। এমনকি ক্ষতিপূরণের অর্থ যেন ভিকটিম নিজে পায় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।