প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৩৩ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
ভোরের পাতা ডেস্ককথায় কথায় জীবনটা আবার নতুন করে শুরুর কথা বলেন অনেকে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় না। কারণ, তেমন কৌশল তো মানুষের আয়ত্তে নেই। এই নিয়ে হাহুতাশ করেও কোনো লাভ হয় না। কিন্তু এবার আক্ষরিক অর্থে না হলেও জীবন পুনঃলিখনের তত্ত্ব দিয়ে রসায়নে নোবেল বিজয় করলেন দুই বিজ্ঞানী। গতকাল বুধবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস রসায়নে নোবেল ঘোষণা করে। জিন সম্পাদনার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে বিশেষ অবদান রেখে এবার এ নোবেল জয় করে নিয়েছেন ফরাসি বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ও মার্কিন বিজ্ঞানী জেনিফার এ ডাউডনা। এ সম্পর্কিত প্রেস বিজ্ঞাপ্তিতে নোবেল কমিটি জানায়, জিন সম্পাদনার কৌশল উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ও জেনিফার এ ডাউডনা। ফরাসি অণুজীববিজ্ঞানী শারপঁসিয়ে বর্তমানে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইউনিট ফর দ্য সায়েন্স অব প্যাথোজেনসের পরিচালক হিসেবে কর্মরত। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া শারপঁসিয়ে প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি করেন। আর মার্কিন বিজ্ঞানী জেনিফার এ ডাউডনা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ১৯৬৪ সালে জন্ম নেওয়া ডাউডনার যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, বোস্টন থেকে পিএইচডি করেছেন। তারা দুজনই জিন সম্পাদনার কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এ দুই বিজ্ঞানী এবার নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার (প্রায় ১১ লাখ ২১ হাজার ডলার) অর্ধেক করে পাবেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শারপঁসিয়ে ও ডাউডনা জিন সম্পাদনার জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুক্ষ্ম প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। নিজেদের উদ্ভাবিত জেনেটিক সিজর (সিআরআইএসপিআর/সিএএস-নাইন) বা জেনেটিক কাঁচি ব্যবহার করে তাঁরা বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের ডিএনএ খুবই দক্ষতার সঙ্গে ও নির্ভুলভাবে পরিবর্তন করেছেন। প্রাণবিজ্ঞানের ওপর তাঁদের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তির প্রভাব অকল্পনীয়। ক্যানসার চিকিৎসাকে এগিয়ে নিতে এই প্রযুক্তি এরই মধ্যে বড় অবদান রেখেছে, যা ভবিষ্যতে বিশ্ববাসীকে এমনকি বহুল প্রতীক্ষিত সুসংবাদও দিতে পারে। এ ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রোগের চিকিৎসায়ও এই প্রযুক্তি আশার আলো হয়ে সামনে এসেছে। নানা প্রয়োজনেই কোষের ভেতরে থাকা জিনে রূপান্তর ঘটানোর প্রয়োজন হয় গবেষকদের। অনেক সময় জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনেও এটি জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু এই জিন সম্পাদনার বিষয়টিতে বেশ সময় লাগে। কখনো কখনো যে সূক্ষ্ম পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তা সম্পাদন করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরেই এর একটি সহজ সমাধান খুঁজছিলেন বিজ্ঞানীরা। ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ও জেনিফার এ ডাউডনা ঠিক এই প্রতীক্ষিত দাওয়াইটিই হাজির করেছেন বিজ্ঞানীদের সামনে। তাঁদের উদ্ভাবিত জেনেটিক কাঁচি দিয়ে খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তনও নির্ভুল ও আগের তুলনায় অনেক দ্রুত করা যায়। তাঁদের কল্যাণে প্রাণের লিপি বদলে দেওয়ার কাজটি এখন কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার মাত্র। নোবেল কমিটি ফর কেমিস্ট্রির চেয়ারপারসন ক্লেস গুস্তাফসন বলেন, ‘এই জেনেটিক হাতিয়ারটির ভীষণ শক্তিশালী, যার সরাসরি প্রভাব রয়েছে আমাদের সবার ওপর। এটি ধ্রুপদি বিজ্ঞানেই শুধু বিপ্লব আনেনি, সঙ্গে নিয়ে এসেছে বহু নতুন ফসল ও চিকিৎসাপদ্ধতির সম্ভাবনা।’ বিজ্ঞানে যেমনটা হরহামেশাই ঘটে, ঠিক তেমনি এই জেনেটিক কাঁচির উদ্ভাবনও হয়েছে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে। মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে একটি স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজিনস। এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করার সময় ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ট্র্যাকআরআরএনএ নামের নতুন এক অণুর সন্ধান পান। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখেন, এই অণু ব্যাকটেরিয়ার প্রাচীন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ, যা আক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএ চিরে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ধরাশায়ী করে। এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই সিআরইএসপিআর/সিএএস নামে পরিচিত।
শারপঁসিয়ে তাঁর এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি ২০১১ সালে প্রকাশ করেন। একই বছর তিনি জেনিফার এ ডাউডনার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করেন। আরএনএ সম্পর্কে বিষদ জ্ঞানের অধিকারী অভিজ্ঞ প্রাণরসায়নবিদ ডাউডনার সঙ্গে তাঁর এ মেলবন্ধন প্রাণের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা দুজন ব্যাকটেরিয়ায় থাকা এই জেনেটিক কাঁচি টেস্ট টিউবে পুনরুৎপাদন করেন এবং ব্যবহারের সুবিধার জন্য এর আণবিক গঠনকে আরও সরলীকরণ করেন। পরে তাঁরা এই জেনেটিক কাঁচি বা সিজররে ধরনে বদল আনেন, যা বলা যায় এক নতুন যুগের দিশা দিল সবাইকে। প্রাকৃতিকভাবে ব্যাকটেরিয়ায় যে জেনেটিক কাঁচিটি থাকে, তা ভাইরাসের ডিএনএ চিনতে পারে। শারপঁসিয়ে ও ডাউডনা একে সম্পাদনা করে এমনভাবে বদলে দিলেন, যাতে এটি বিজ্ঞানীদের কথা শোনে। তাঁদের উদ্ভাবিত এই নতুন জেনেটিক কাঁচিটি যেকোনো ডিএনএকে শনাক্ত করতে পারে এবং এর যেকোনো অংশে এটি কাঁচি চালাবার কাজটি করতে পারে, যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে বিজ্ঞানীদের হাতে। প্রাণ পুনঃলিখনের জন্য এই ডিএনএ কাটাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্ধারিত স্থানে ডিএনএ কাটার পর তাতে পুনঃলিখন করাটা সহজ। ২০১২ সালে এসে এই দুই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত জেনেটিক কাঁচিটি হাতে আসার পর গবেষণার দুনিয়ায় রীতিমতো বিপ্লব হয়ে গেছে বলা যায়। এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত বহু নতুন ফসলের সন্ধান দিয়েছেন, যা খরা ও বন্যাকবলিত অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য জরুরি। এমনকি কীটপতঙ্গের আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এমন ফসলেরও সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁদের এই প্রযুক্তির কল্যাণে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে ক্যানসার চিকিৎসায় এটি বড় ধরনের অগ্রগতি এনে দিয়েছে মানুষকে।