মোংলা বন্দরে হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে উঠেছে দুষ্ট চক্র। ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য আমদানি না করা, পণ্যবিহীন খালি কন্টেইনার আসা এবং আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আমদানিসহ শুল্ক ফাঁকির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। কাস্টমস শুল্ক বিভাগের গেল একমাসের নজরদারীতে উঠে এসেছে এ সব তথ্য। এ বন্দরে দুদফায় আসা আমদানিকৃত সাড়ে ৩ কোটি টাকা সমমূল্য পণ্যের হদিস নেই। ঘোষণা পত্র ও কাগজ-কলমে থাকলেও মিল নেই বাস্তবে। বন্দরে আসা পণ্যের কায়িক পরীক্ষায় ধরা পড়ে এসব গড়মিল। সর্বশেষ গেল সপ্তাহে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৩১ টন পণ্য আসার ঘোষণা থাকলেও কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া গেছে মাত্র ৭ টন। বন্দরে আসা এ পণ্যে চালানটির ২৪ টনই পাওয়া যায়নি। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা।
এর আগে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৫৬ টন পণ্যের (কাপড়ের) মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ৪০ টন কাপড়ের খোঁজ মেলেনি। সিল ও লগ করা কন্টেইনার থেকে পণ্য (কাপড়) গায়েব হওয়ার এ ঘটনা ঘটেছে। চীন থেকে আসা দুদফায় দুটি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্যের কুলকিনারা করতে পারছে না কাস্টমস। আর এ ক্ষেত্রে ৩ কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে কাস্টমস। এ ছাড়া পণ্য আমদানির ঘোষণা থাকলেও খালি কন্টেইনার আসার ঘটনা ঘটেছে বন্দরে। একের পর এমন ঘটনা মোংলা বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তুলছে। তাই পণ্য চুরি ও দুষ্ট চক্রের তৎপরতা, মানিলন্ডরিং এবং শুল্ক ফাঁকিসহ ত্রিমুখী প্রশ্ন মাথায় রেখেইে নেপথ্যের ঘটনা উদ্ঘটনে সামনে এগুচ্ছে কাস্টমস।
মোংলা বন্দর ও কাস্টমস ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার কোতোয়ালীর আহসানুল্লা সড়কের ১/১২৫ ঠিকানার মেসার্স নামিরা এন্টারপ্রাইজ এলসিথর মাধ্যমে চীন থেকে ৩১ টন (৩১ হাজার কেজি) থান কাপড়ের রোল আমদানি করে। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি কন্টেইনার যোগে কাপড়ের এ চালানটি গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌঁছায় মোংলা বন্দরে। আর এ কাপড়ের চালানটি আসার পর কাস্টমস শুল্ক প্রদান প্রক্রিয়ায় ছাড় করাতে তেমন একটি তৎপরতা ছিল না আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। যে কারনে টানা ৫ মাস ধরে কন্টেইনারে থাকা আমাদানিকৃত কাপড়ের চালানটি বন্দরের কন্টেইনার ইয়ার্ডে পড়ে থাকে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা এ কাপড়ের চালানের শুল্ক প্রদান করে ছাড় করিয়ে নিতে আমদানিকারককে তাগিদ দেয় কাস্টমস।
এ প্রেক্ষিতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সম্মতিতে পণ্যের কায়িক পরীক্ষার দিনক্ষণ ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয় নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে কাস্টমস। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা কাপড়ের কন্টেইনারটি খোলা হয়। এ সময় আমদানিকারকের ঘোষণা পত্র আনুয়ায়ী ওজন করা হলে ৩১ টনের পরিবর্তে মাত্র ৭ টন কাপড় পাওয়া যায়। বাকী ২৪ টন কাপড় কোথায় গেল তা নিয়ে হরেক রকম প্রশ্ন ওঠে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স আবুল হাসান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোঃ মাসুদ রানা জানান, মোংলা বন্দরের কন্টেইনার ইয়ার্ডের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে পণ্য (কাপড়) হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমদানিকারকের মানিলন্ডরিং অথবা কন্টেইনার আসা জাহাজ ও পথিমধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয় সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সংশ্লিষ্ট সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে সংগৃহীত মেসার্স নামিরা এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি জনৈক পরশের সঙ্গে তার ব্যবহৃত (০১৯২১০৩৬৫১৪) মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি কাস্টমস ও সিএ্যান্ডএফর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে তার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে ফোনালাপ করিয়ে দিতে ঘন্টা খানেক পরে আবার ফোন করতে বলেন। দ্বিতীয় দফায় দুপুর ২টার দিকে ওই নাম্বারে ফোন করলে মুঠো ফোনালাপে পরশ নামের ওই ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং জানান প্রতিষ্ঠানের মালিক অসুস্থ থাকায় কথা বলা যাবে না।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর ৪০ ফুট দৈঘের দুটি কন্টেইনারে ৫৬ টন কাপড় আমদানি করে মিসোর্স জিম এ্যান্ড জেসি কমজিট লিমিটেড নামের একটি অপর একটি প্রতিষ্ঠান। ওই দুটি কন্টেইনারে ৬শ ৬১ বেল্ট (রোল) কাপড় থাকার কথা থাকলেও কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া যায় মাত্র ২শ ১৬ বেল্ট কাপড়। বন্দরের আসার পর পরই কাস্টমসের কায়িক পরীক্ষায় ৪শ ৪৫ বেল্ট সমপরিমাণ ৪০ টন কাপড়ের সন্ধান মেলেনি। এ অবস্থায় কন্টেইনারবাহী জাহাজ বিভিন্ন দেশ ও বন্দর ঘুরে মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। এ সকল বন্দর অতিক্রমকালে পথিমধ্যে নাকি মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর পর ওই পণ্য (কাপড়) লোপাট কিংবা আমদানিকারক নামমাত্র এলসির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ (মানিলন্ডরিং) করেছে কিনা ঘুরে ফিরে এ সকল প্রশ্ন উঠেছে। আর এ সব বিষয় নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানও চালাচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কন্টেইনার থেকে পণ্য উধাও হওয়ার ঘটনা ছাড়াও আমদানি পণ্যের ঘোষণার বিপরীতে খালী কন্টেইনার পৌঁছানোর ঘটনাও ঘটেছে মোংলা বন্দরে। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর মেসার্স সোবাহানাল্লা ট্রেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকলে পেম্পার, ডায়াপার ও পার্টি স্প্রে আমদানির ঘোষণায় ৪০ ফুট দৈঘের একটি পণ্যবাহী কন্টেইনার আসে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাড়া না পেয়ে এ কন্টেইনারটির কায়িক পরীক্ষায় কোন প্রকার পণ্য মেলনি। কাগজে কলমে এ প্রতিষ্ঠানের নামে রাজশাহীর একজিম ব্যাংকে এলসি দেখানো হয়। বাস্তবে আমদানিকারক এ প্রতিষ্ঠানের নামে ওই ব্যাংকে কোন এ্যাকাউন্ট এবং এলসি খোলার তথ্য-উপাত্তা খুঁজে পায়নি কাস্টমস। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কাস্টমস বাদী হয়ে শিপিং এজেন্ট সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এ মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ইকবাল বাহার চৌধুরী। এ বিষয় মেসার্স সোবাহানাল্লা ট্রেড এর স্বত্বাধিকারী এস এম মনিরুজ্জামান জানান, একটি চক্র পরিকল্পিত ভাবে তার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার ও সুনাম নষ্ট করতে চক্রান্ত করছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।
অপর দিকে গত ১৩ আগস্ট টেনিসবল আমদানির ঘোষণা দিয়ে আনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা সমমূল্যের ৮০ মেট্রিক আমদানি নিষিদ্ধ পোস্তদানার চালান আটক করে কাস্টমসের শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগ। এ ঘটনার ৩ দিন পর আমদানিকারক ঢাকার চকবাজারের মেসার্স তাজ ট্রেডার্স ও মেসার্স আয়শা ট্রেডার্স এবং মেসার্স ওসান ট্রেডার্স নামক শিপিং এজেন্ট বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে কাস্টমম। একই সঙ্গে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দুটির এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। এ মামলাটি তদন্ত করছে মোংলা থানা পুলিশ। গত দুমাসের ব্যবধানে দুথদফায় মোংলা বন্দরে আসা কন্টেইনারের পণ্য গায়েব, পণ্যবিহীন আসা খালি কন্টেইনার এবং আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটেছে। মোংলা কাস্টমস হাউজের ডেপুটি কমিশনার সুমন দাস জানান-আমদানি পণ্যের ঘোষিত মূল্যের উপর ৯০ শতাংশ শুল্ক আদায় করে থাকে কাস্টমস। সেই হিসেবে দুদফায় আমদানি কাপড়ের সিংহভাগের হাদিস না পাওয়ায় ৩ কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে কাস্টমস।
ঘোষণা অনুযায়ী আমদানি পণ্য না পাওয়ার ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাগেরহাট চেম্বারের সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে। তবে ঘটনা খতিয়ে দেখতে লেডিং পয়েন্ট থেকে শুরু করে পণ্য খালাস হওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধানী টিম গঠন করা জরুরি। একই সঙ্গে পণ্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং সুরাহ না হলে মোংলা বন্দরের সুনাম নষ্ট হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বন্দরে আসা কন্টেইনারের পণ্য কম পাওয়া প্রসঙ্গে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাজান জানান, মোংলা বন্দর জেটি সংরক্ষিত এলাকা। সিসি ক্যামরা ছাড়াও জেটি, ইয়ার্ড গেটে তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। এ বন্দর আসা কন্টেইনারজাত পণ্য খোয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে মানিলন্ডরিং সহ ব্যবসায়িক দুষ্ট চক্র মোংলা বন্দরের সুনাম নষ্ট করতে চাইছে বলে জানান তিনি।
নেপথ্যের ঘটনা উদ্ঘাটনে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন বলে জানালেন মোংলা কাস্টমস হাউজের কমিশনার হোসেন আহম্মেদ। দাপ্তরিক কার্যক্রমে জনবল সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন-ঘোষিত পণ্যের সঠিক পরিমাণ না পাওয়া এবং বন্দরে খালি কন্টেইনার আসার ৩টি ঘটনাই আপাতত মানিলন্ডরিং হিসেবে দেখছেন তারা। তাই এ বিষয় ইতিমধ্যে মোংলা থানায় একটি মামলা দায়েরসহ আরও দুটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।