প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১:০৫ এএম আপডেট: ২৯.০৯.২০২০ ১:১১ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
সঞ্জু স্যামসনের দুরন্ত ব্যাটিং :প্রায় হাতের বাইরে চলে যাওয়া ম্যাচ জিতে নিল রাজস্থান রয়্যালস। রুদ্ধশ্বাস এই ম্যাচ যে স্টিভ স্মিথের দল জিতে নেবে, তা হয়তো অতি বড় রাজস্থান সমর্থকরাও ভাবেননি। প্রথমে স্টিভ স্মিথ (২৭ বলে ৫০), পরে সঞ্জু স্যামসন (৪২ বলে ৮৫), রাহুল তেওয়াটিয়া (৩১ বলে ৫৩) ও জোফ্রা আর্চারের (৩ বলে ১৩) ঝড়ে আকাশে উড়া পাঞ্জাবকে মাটিতে নামালো রাজস্থান। পাঞ্জাবের পর্বত প্রমাণ ২২৩ রান তাড়া করতে নেমে ১৫ ওভারে রাজস্থানের রান ছিল ২ উইকেটে ১৪০। জেতার জন্য আস্কিং রেট বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয়ার উপক্রম হয়েছিল। ৩০ বলে দরকার ৮৪ রান। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে পাল্টা মারের খেলা শুরু করে রাজস্থান। স্টিভ স্মিথের দলের ব্যাটসম্যানদের মারকুটে ব্যাটিংয়ে কটরেল-শামিদের মতো আন্তর্জাতিক মানের বোলাররা করতে থাকেন একের পর এক ভুল। রান আটকানোর পরিবর্তে একগাদা রান দিয়ে রাজস্থানের জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করে দেন তাঁরা।চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে আগের ম্যাচে ৩২ বলে ৭৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সঞ্জু। সচিন তেন্ডুলকর, সুনীল গাওস্করের মতো কিংবদন্তিরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন সেই ইনিংসের। গৌতম গম্ভীর তো বলেই দিয়েছিলেন, একমাত্র জাতীয় দল ছাড়া সর্বত্রই স্বাগত সঞ্জু! এ দিনও কথা বলল সঞ্জুর ব্যাট। করলেন ৪২ বলে ৮৫। এদিনের ম্যাচের সেরাও তিনি।
রাহুল তেওয়াটিয়া : প্রথমে যখন তিনি ব্যাট করতে নামেন তখন মনে হয়েছিল তাকে দিয়ে টেস্ট খেলানো যেতে পারে কিন্তু সংক্ষিপ্ত সংস্করণের এই টি টয়েন্টিতে তিনি একেবারেই বে মানান। সমর্থকরা তো বটেই তার ব্যাটিং করার ধরন দেখে সতীর্থরাও বিরক্ত। ধারাভাষ্যকারেরা তো তাকে আগামী জাতীয় দলের টেস্টে নাম তুলে দিতেও পিছপা হননি। আর হবেনই বা না কেন যখন ১৯ বলে তার ব্যাট থেকে আস মাত্র ৯টি রান! এক ধারাভাষ্যকার তো বলেই দিলেন কোন অভিপ্রায়ে এমন নবিশ ব্যাটসম্যানকে দলীয় অধিনায়ক এই দুসময়ে পাঠালেন তা ভাবলে অবাক হতে হচ্ছে। দলের যখন ২০বলে ৬৪ রানের দরকার তখন তার সংগ্রহ মাত্র ০৯! তবে রাহুল তেওয়াটিয়া ভেবেছিলেন অন্য রকম। তিনি সেই গানের মত বলছিলেন, ‘তোমরা যতই আঘাত করো নেইতো অভিমান/ আমি শুধু চাই গো সুযোগ তলোয়ার করতে এই ব্যাট’। সত্যিই সেই রাহুল তেওয়াটিয়া এই ম্যাচের গেম চেঞ্জার। এক সময়ে ১৯ বলে ৮ রান করা সেই তেওয়াটিয়া ক্যারিবিয়ান পেসার শেলডন কটরেলের (১৮ তম) ওভারে পাঁচটা ছক্কা হাঁকিয়ে ৩০ রান নেন। তাঁর এই মহা বিস্ফোরণ ম্যাচের রং বদলে দেয়। জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করে রাজস্থান শিবির।
শেষের দুই ওভার : শেষ ২ ওভারে রাজস্থানের দরকার ছিল ২১ রান। লোকেশ রাহুল বল তুলে দেন মহম্মদ শামির হাতে। দারুণ ইয়র্কার দিতে পারেন বঙ্গ পেসার। এ দিন মোক্ষম সময়ে ইয়র্কারের বদলে লেন্থ বল ফেলতে থাকেন শামি। আর সেই সুযোগ নিয়ে তাঁর ওভারে ১৯ রান নেয় রাজস্থান। সেই ওভারেই শামি রাজস্থানের দুই ব্যাটসম্যান রবিন উথাপ্পা ও তেওয়াটিয়াকে ফেরান।কিন্তু তত ক্ষণে ম্যাচ বেরিয়ে যায় পাঞ্জাবের হাত থেকে। শেষ ওভারে মুরুগান অশ্বিনের বলে রিয়ান পরাগ আউট হলেও তিন বল বাকি থাকতে চার উইকেটে ম্যাচ জিততে সমস্যা হয়নি স্মিথের দলের।
রাজস্থানের রেকর্ড : আইপিএলের ইতিহাসে রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড গড়ল রাজস্থান। এর আগে এই রেকর্ড ছিল তাদেরই দখলে। ২০০৮ সালে ডেকান চার্জার্সের ২১৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল রাজস্থান। তখন অবশ্য রাজস্থানে শেন ওয়ার্ন জমানা। এ দিন নিজেদের রেকর্ড নিজেরাই ভাঙল।টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২২৩ রানও যে নিরাপদ নয়, তা দেখিয়ে দিল এদিনের ম্যাচ। কাজে এল না ময়ঙ্ক আগরওয়ালের দুরন্ত সেঞ্চুরিও।
ময়ঙ্ক আগরওয়াল : সত্যিই তিনি ট্রাজিক হিরো। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ‘গ্লোরি শট’ মারতে গিয়ে দলকে ডুবিয়েছিলেন ময়ঙ্ক। ছয় মেরে ম্যাচ শেষ করার চেষ্টায় ফুলটস জমা দিয়েছিলেন ফিল্ডারের হাতে। মুহূর্তের ভুলে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে পারেননি তিনি। ৬০ বলে ৮৯ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে সেই ম্যাচে ট্র্যাজিক হিরো হতে হয়েছিল তাঁকে। গত রোববারও একই ইতিহাসে জমা হলো তার শতকটি।মাত্র ৫০ বলে ১০৬ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেললেন। মারলেন ১০টি বাউন্ডারি ও ৭টি ওভার বাউন্ডারি।দলকে উড়ন্ত সূচনা আর রানের হিমালয়ে তুলে দিয়েও জয়বঞ্চিত হলো তার দল।ওপেনিং পার্টনারশিপে ময়ঙ্ক ও রাহুল করলেন ১৮৩ রান। অল্পের জন্য ভাঙতে পারলেন না ডেভিড ওয়ার্নার ও জনি বেয়ারস্টোর রেকর্ড। হায়দরাবাদের দুই ওপেনার গত বারের আইপিএলে ১৮৫ রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে। এ দিন সেই রেকর্ডও প্রায় ভাঙতে বসেছিল। টম কারেনের বলে ময়ঙ্ক আউট হয়ে যাওয়ায় ওয়ার্নার-বেয়ারস্টোর রেকর্ড অক্ষত থেকে যায়। এ দিন টসের আগে সবাই বলছিলেন, শারজার পিচে রান আছে। যে দল টস জিতবে, সেই দলই প্রথমে ব্যাট করবে। রাজস্থান অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ অন্য পথে হাঁটলেন। টস জিতে পাঞ্জাবকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠান অজি তারকা। শুরু থেকেই ময়ঙ্ক ও রাহুল এক্সপ্রেস গতিতে ছুটতে শুরু করলেন। একটা সময়ে দুই ওপেনারই প্রায় একই গতিতে রান তুলছিলেন। কিন্তু খেলা যত গড়াতে থাকে ময়ঙ্ক ছাপিয়ে যান রাহুলকে। পাঞ্জাব অধিনায়কও তখন ময়ঙ্ককে স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন। আর ময়ঙ্ক ঠান্ডা মাথায় রাজস্থান বোলারদের মাঠের বাইরে পাঠাচ্ছিলেন। কোন লেন্থে ময়ঙ্ককে বল করবেন তাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না জয়দেব উনাদকাট, টম কারেন, জোফ্রা আর্চাররা। ২৬ বলে ময়ঙ্ক করেন ৫৪ রান। পরে আরও নির্দয় হয়ে ওঠেন তিনি। সেঞ্চুরি করেন ৪৫ বলে। প্রতিটি শটে ছিল ক্রিকেট। তাঁর ‘ক্লিন হিট’-এর জবাব ছিল না রাজস্থান বোলারদের কাছে।
ওয়ার্ন ও হর্ষের টুইট যুদ্ধ :গত রোববার পাঞ্জাব বনাম রাজস্থানের ম্যাচে ঝড় তুললেন পঞ্জাবের দুই ওপেনার। ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন পাঞ্জাব অধিনায়ক লোকেশ রাহুল। রাজস্থানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করলেন ময়ঙ্ক আগরওয়াল (১০৬)। দুই ওপেনারের ব্যাট থেকে ১৭টি চার এবং আটটি ছক্কা বর্ষিত হয়। শারজার মাঠে তখন ঝড় তুলেছিলেন ময়ঙ্ক-রাহুল। তাঁদের মারা শট আছড়ে পড়ছিল মাঠের বাইরে। ঠিক সেই সময়ে হর্ষ ভোগলের এক টুইটকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে।হর্ষ টুইট করে লেখেন, ‘এটা শুধু স্লগ করা নয়। দুর্দান্ত ব্যাটিং। নব্বইয়ের দশকে খেলা কভার করতে এসে এই মাঠটাকে এত ছোট মনে হতো না।’ আর হর্ষের এই টুইট ভাল ভাবে নেননি রাজস্থান রয়্যালসের মেন্টর শেন ওয়ার্ন।পাল্টা টুইট করে তিনি জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, এটা প্লেয়াররাই করে দেখিয়েছে। ভাগ্যিস, তুমি বোলার ছিলে না।’ বিখ্যাত অজি লেগ স্পিনারের টুইটের পরক্ষণেই আবার টুইট করেন হর্ষ। তিনি বলেন, ‘সেই সময়ে খেলাটাও অন্য ভাবে হতো। নব্বইয়ের দশকে ওয়ান ডে ক্রিকেটে ১০৮টি ইনিংসে গড় রান ছিল ২২৭।’ তাতে আরও রেগে যান রাজস্থানকে প্রথম আইপিএল ট্রফি দেওয়া অধিনায়ক। ওয়ার্ন বলেন, ‘পরিসংখ্যান সব সময় সঠিক কথা বলে না। সেই সময়ে সব দেশের বোলাররা অনেক ভাল ছিল আর পিচও ছিল অন্যরকমের। যাই হোক, রাজস্থান এখনও জিততে পারে। ২১০ রান করা সম্ভব।’পাঞ্জাব অবশ্য থামে ২২৩ রানে। ওয়ার্নের সেই টুইটে হর্ষ কমেন্ট করে বলেন, ‘ঠিক, রয়্যালসের বোলিংও খুব ভাল।’এদিন ময়ঙ্ক-রাহুল রাজস্থানের বোলিং নিয়ে ছেলেখেলা করেন। স্টিভ স্মিথের দলের বোলিং নিয়ে কটাক্ষ করেন হর্ষ।
ভারতীয়দের রসবোধ কম :সুনিল গাভাস্কারের পরিস্থিতি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের সাবেক এই কিপার-ব্যাটসম্যান নিজেও একবার পড়েছিলেন এই বিপাকে। এবার দাঁড়ালেন এক সময়ের সতীর্থের পাশে। তার মতে, মজার ছলেই বিরাট কোহলিকে নিয়ে বলার সময় আনুশকা শর্মাকে ক্রিকেটে টেনে এনেছিলেন গাভাস্কার।আইপিএলে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের গত বৃহস্পতিবারের ম্যাচে কোহলির অনুশীলনের ঘাটতি নিয়ে আকাশ চোপড়ার সঙ্গে কথা বলছিলেন গাভাস্কার। লকডাউনে ভারতীয় অধিনায়কের কেবল স্ত্রী আনুশকার বোলিংয়ের বিপক্ষে ব্যাটিং অনুশীলনের সুযোগ ছিল, এমন মন্তব্য করেন তিনি। সে সময়ের ৩৪ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।যা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আনুশকাও। পরে ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তি গাভাস্কার নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। জানান, তার কথাকে অন্যভাবে নেওয়া হয়েছে। ফারুক মনে করেন, ভারতীয়রা রসকষহীন বলেই জল এতো দূর গড়িয়েছে।