মো. শহীদ উল্লা খন্দাকার
কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা ডোরোটেয়া মার্কেল এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা কেট লরেল আরর্ডার্ন যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এই দুই নারী নেতার গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়। মহামারী করোনা জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বজুড়েই আঘাত হানে। ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত সব দেশই কমবেশি বিপর্যস্ত হয় এর ছোবলে। এই মহামারীর ঢেউ এসে আঘাত হানে বাংলাদেশেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই করোনাকে সামাল দিতে পারলেও নারী নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মার্কেল ও জেসিন্ডাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম সেভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ পয়েছেে কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে হতোদ্যম হননি। করোনা মোকাবেলায় তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছেন। আশা করা যায়, তাঁর নিরলস পরিশ্রম ও অদম্য মনোবলের কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই করোনা মোকাবলোয় বাংলাদেশ ইতবিাচক ফলাফল নিয়ে আসবে।
মার্কেল ও জেসিন্ডা বেশ প্রশংসা কুড়ালেও জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবে বিদায় নেয়নি। এই দুই নারী নেতার পক্ষে কেন করোনাকে তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
করোনা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। করোনা মোকোবেলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনবিরল দেশে এই ভাইরাস মোকাবেলা যত সহজে সম্ভব, জনবহুল দেশে তা তত সহজ নয়। জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের পক্ষে করোনা নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হয়েছে মূলত দেশ দু’টির বিশাল আয়তনের বিপরীতে কম জনসংখ্যার কারণে।
জার্মানির আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ। জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জার্মানির তুলনায় বাংলাদেশে প্রায় ছয় গুণ বেশি মানুষ বসবাস করে। অপরদিকে নিউজিল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ ভাগের এক ভাগ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে নিউজিল্যান্ডের তুলনায় বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ গুণ বেশি মানুষ বসবাস করে। সে হিসেবে বলা যায়, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাংলাদেশের তুলনায় যেহেতু যথাক্রমে ছয় ও ৭৫ গুণ কম, সেহেতু দেশ দু’টির পক্ষে করোনা মোকাবেলা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অনেক সহজ ছিল। দেশ দু’টির সরকারপ্রধান করোনা মোকাবিলায় বাহ্বা কুড়িয়েছে মূলত বিশাল আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দেশ দুটি বিরল জনসংখ্যার দেশ হওয়ার কারণে।
আগেই বলেছি, জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী এবং আয়তন যা-ই হোক এটি বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। সে হিসেবে, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের পক্ষে করোনা মোকাবেলা যতটা সহজ হয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে ততটা সহজ ছিল না। যে দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ২০০ লোক বসবাস করে, সে দেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কষ্টসাধ্য হওয়ায় করোনা সর্বগ্রাসী রূপে আর্বিভূত হওয়ারই কথা। বাংলাদেশে কিন্তু তা হয়নি। এখানে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ৬৪ জন ( ২৯ জুন)। এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত ৩ হাজার ১৭১ জন ( ৯ জুন)। দেখা যাচ্ছে, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে এক দিনে হাজার মৃত্যু দূরে থাক, শত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। এর জন্য সৃষ্টিকর্তার রহমতের পাশাপাশি সঠিক নেতৃত্বও ভূমিকা রেখেছে। এক দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো উন্নত দেশে যেখানে ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ করোনা রোগী শনাক্তের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বাংলাদেশ এই সংখ্যাকে ৩ হাজার ১৭১ জনের উপরে ওঠেনি। এখানেও সৃষ্টিকর্তার রহমতের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্ব ও সময় উপযোগী পদক্ষপে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে করোনাকে ‘অতিমারী’ রূপে আবির্ভূত হতে দেননি। এ জন্য সরকারপ্রধান হিসেবে সৃষ্টিকর্তার রহমত যে তাঁর উপর আছে, বলে আমরা বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের মতো ১৭ কোটি জনসংখ্যা জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের হলে দেশ দু’টিতে কী হতো বলা মুশকিল, তবে এটা বলা যায়, জার্মানিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে যতজন লোক বসবাস করে, রাজধানী ঢাকার একটি মহল্লায় তার অন্তত ২০ গুণ বেশি লোক বসবাস করে। নিউজিল্যান্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে যতজন লোক বসবাস করে, ঢাকার একটি বহুতল ভবনে তার অন্তত ৫০ গুণ বেশি লোক বসবাস করে। সে হিসেবে, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের করোনা মোকাবেলা আর বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলাকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়। এতসব সুবিধা নিয়েও মার্কেল ও জেসিন্ডা করোনা মোকাবেলায় যেভাবে গলদঘর্ম হয়েছেন, সীমিত আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়চত্তিে তা মোকাবেলা করে চলেছেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনেক উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশকে করোনা মোকাবেলায় রোগীদের ঠাঁই দেয়ার জন্য তাবু খাটাতে হয়নি এবং গণকবর খুঁড়ার মত অনাকাংক্ষতি পরস্থিতিরি সম্মূখীন হতে হয়নি। এটা ঠিক, করোনা মোকাবেলায় র্সাবকি পরস্থিতিি ববিচেনায় এখানেও লকডাউন দিতে হয়েছে, আবার অর্থনীতির চাকা সচলের জন্য যথাসময়ে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলেও নেয়া হয়েছে। লকডাউনের সময়ে ৫০ লাখ পরিবারের প্রত্যেককে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ র্অথ সহায়তা দেয়া সীমিত সম্পদের বাংলাদেশের পক্ষে একটি সাহসী পদক্ষপে বলে মনে কর।ি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বপিুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেয়াও সহজ কাজ ছিল না। ইতমিধ্যে দেশের প্রায় চার কোটি পরিবার এই খাদ্য সহায়তার আওতায় এসেছে। পাশাপাশি ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণ এখনও অব্যাহত আছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। প্রথমে তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন, পরে অন্যান্য খাতের জন্য আরো ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। বলা যায়, জিডিপির আড়াই শতাংশের বেশি প্রণোদনা ঘোষণা করায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েনি এবং তৈরি পোশাক শিল্প সচল থাকায় এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় কোটি পরিবার র্অথরে অভাবে খাদ্যসংকটে পড়েনি।
কভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা যখন গোটা জাতকিে ভাবয়িে তুলছেে ঠকি তখন দেশের ২৪টি জেলা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে শঙ্কিত ছলিাম আমরা। অনেকে আত্মপ্রসাদে ভুগছিল যে, বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ অবস্থা সরকার কিছুতেই সামাল দিতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশকে সে অবস্থায় উপনীত হতে হয়নি। করোনায় এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি (উন্নত বিশ্বের তুলনায় যা কম) মানুষের মৃত্যু ঘটলেও, খাদ্যের অভাবে আমাদরে দশেে মানুষের মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটনেি । বলা যায়, এদশে সঠিক পথেই আছে এবং সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে এত কিছু একসঙ্গে সামাল দেয়া কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? দেশ পরিচালনায় তাঁর প্রত্যুৎপন্নিমতা এক্ষেত্রে নিয়ামক হলেও অনেকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দেশপ্রেম ধারণ করতেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও ঠিক ততটুকু দেশপ্রেমই ধারণ করেন। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য জাতির পিতা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও বলেছেন, এই দেশ ও এই জাতির জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
২৮ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেয়ার কারণে ২০০৯ সাল থেকে টানা ১১ বছর তাঁকে তাঁর জন্মদিন যুক্তরাষ্ট্রে পালন করতে হয়েছে। এবারও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন হচ্ছে। তবে বশ্বৈকি করোনা মহামারীর কারণে এবারের অধিবেশন হচ্ছে ভার্চুয়াল। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে দেশে থেকেই ভাষণ দিয়েছেন। এতে ১১ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রিয় মাতৃভূমতিে জন্মদিন পালন করতে পারছেন।
এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, দেশে অবস্থান করতে না পারায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে অনেক বছর ঘটা করে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করেননি। তিনি সবার আগে ভাবেন দেশ নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে। করোনার রাহুগ্রাস থেকে তিনি গোটা জাতিকে কীভাবে রক্ষা করবেন, তা-ই তাঁর অহোরাত্রির ভাবনা। প্রবল দেশপ্রেম ও বাংলা ভাষার জন্য তাঁর ভালোবাসার কারণে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো প্রধানমন্ত্রিত্বের তিন মেয়াদে মোট ১৫ বার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। জাতির পিতা তাঁর ভাষণে গণতন্ত্র, ন্যয়পরায়ণতা, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি অবিচল আস্থা পোষণ করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও গণতন্ত্র, বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং ক্ষুধা ও পরমাণু অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এসবের পাশাপাশি এবারের অধিবেশনে তিনি রোহিঙ্গা ও করোনা সংকট মোকাবেলায় তার ভাবনার কথাও ভাষণে তুলে ধরেছেন।
করোনা সংকট মোকাবেলায় অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও জেসিন্ডা আরর্ডার্নের মতো বিপুল সম্পদের সহায়তা তিনি পাননি। সীমিত সম্পদ ও আয়তন এবং বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি দৃঢ়তার সাথে করোনার আগ্রাসন মোকাবেলা করে চলেছেন। অভজ্ঞি মহলরে মতে করোনা মোকাবেলায় মার্কেল ও জেসিন্ডার মত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেনে ।
৭৪তম জন্মদিনে এই দশেনায়ককে শুভেচ্ছা।
লেখক : মো. শহীদ উল্লা খন্দকার , সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।