ড. কাজী এরতেজা হাসান
১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করতেন। তখনকার ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁকে সে সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একটা চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে মানুষের পাশে থাকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। চিঠিটি নিম্নরূপ, ‘বন্ধুবরেষু গুণ, আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। ‘ত্রাণ বিতরণ করছি’ এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্য দানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজরক্ষার তাগিদে, সঙ্গীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ‘ক্রেডিট’ নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দিবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না। আমি মনে করি, যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাথে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াতে সেটাই গর্ব করার মতো হতো। যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সেদিন কবে আসবে? আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে, আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি। ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কি পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না, একদিন জেগে উঠবেই সেদিন কেউ রেহাই পাবে না। আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন। শুভেচ্ছান্তে, শেখ হাসিনা, ৯. ১০. ৮৮’।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ এই ৭ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ ১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দেশে ফেরা ছিল অতি সাধারণ, কারণ সেভাবেই তিনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এদেশে তার ঘর নেই; ঘরের আপনজনও কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ তার আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈর-শাসকরা বোঝাতে চেয়েছিল তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের। সেনা শাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তার শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা তার প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো।
স্বাধীনতার চার দশক পর হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে করেছেন কলঙ্কমুক্ত। মাথা নত করেননি দেশি-বিদেশি অজস্র চক্রান্তের কাছে। উল্টো সাহসিকতা, মানবিকতা ও নেতৃত্বগুণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেয়েছেন শতাধিক পুরস্কার, অর্জন ও উপাধি। এরই মধ্যে টানা ১০ বছরের শাসনামলে একটি মধ্যম আয়ের দেশের সোপানে তুলে বাস্তবায়ন করেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। দেশের গণ্ডিপেরিয়ে তিনি এখন বিশ্বনেত্রী। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা ও স্থপতি, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তাঁর মাতার নাম বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব। শেখ হাসিনা ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ টুঙ্গিপাড়ায় (টুঙ্গিপাড়া,গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, পূর্ব বাংলা, পাকিস্তান,বর্তমানে বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন এবং বাল্য ও প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই নেন। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় পরিবারের সাথে মোগলটুলির রজনীবোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর হতে ঐতিহাসিক ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বসবাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তিনি সাবেক ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বদরুন্নেসা গার্লস কলেজ ) ও বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী।
শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রখ্যাত পরমানু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ৯ মে, ২০০৯ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের সংসারে সজীব ওয়াজেদ জয় (পুত্র) ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (কন্যা) নামে দুই সন্তান রয়েছেন। তারা দুইজনই আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ। সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে নায়ক এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়নকই নন, তিনি একজন রত্নাগর্ভা মা।
খুব কাছ থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তার সঙ্গে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেখেছি, কতটা নিরহংকারী মানুষ তিনি। ইসলামের প্রতি অন্তপ্রাণ এই মানুষটিকে দেখেছি টানা ২০ ঘন্টার রোজা রেখেছেন। এমনকি হাজার হাজার ফুট ওপরে উড়ন্ত বিমানে বসে কমপাস দিয়ে পশ্চিম দিক নির্ধারণ করে ঠিক সময় মতো নামাজ আদায় করতে। কয়েকদিন আগে মহান জাতীয় সংসদে নিজের প্রাত্যহিক জীবনের কথাও তুলে ধরেছেন। প্রতিদিন কোরআন তেলওয়াত করা থেকে নিজে চা বানিয়ে খাওয়া এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর কারণে আমরা গর্বিত। তার কাছ থেকে আপোষহীনতাও শিখেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হলো, তখন আমি মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করি। এরপর নানা হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সন্তান এবং শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছি। মহামান্য হাইকোর্টে রিট করার পরই নেত্রীর সাথে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে একই বিমানে ছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কারো সঙ্গে আপোষ করা যাবে না। আমি অমিত সাহস নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে গেছি। ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইটির বাজারজাতকৃত ২০০০ কপি বইয়ের মধ্যে ১৯৫৪ টি বই ধ্বংস করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সাহস আমাকে এ লড়াই চালিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করেছে। এছাড়া জামায়াত-বিএনপির লোকেরা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে অথবা আওয়ামী লীগ সরকারকে ইসলাম বিরোধী হিসাবে প্রচারনা চালিয়ে আসছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এমনটা তারা করছিল। তখন জননেত্রীর ধর্মচিন্তা নামে একটি বই বের করি। বইটিতে শেখ হাসিনার ইসলামিক চিন্তাধারা এবং ইসলামের উন্নয়নে, প্রসারে সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরি। এমনকি ৫ লক্ষাধিক বই বিএনপি-জামায়াত এলাকায় বিতরণও করি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে একদল তস্কর খুনী, দুস্কৃতকারী, নিমকহারাম মীর জাফরের প্রেতাত্মা রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক ‘বঙ্গবন্ধু ভবনে’ হানা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতির হাজার বছরের কাঙ্খিত পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার প্রিয়তমা স্ত্রী বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণাদাত্রী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাদের বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল, মেঝো ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, ছোট ছেলে কিশোর শেখ রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে।
একই রাতে তস্কর খুনী দল হানা দেয় বঙ্গবন্ধু সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী অবিসংবাদিত কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের সরকারী বাসভবনে। সেখানে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার কিশোর ছেলে আরিফ, কিশোর মেয়ে বেবী, নাতী ছোট্ট শিশু সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু এবং ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত ও আত্মীয় আবু নাঈম রিন্টুকে। মারাত্মকভাবে আহত করে সেরনিয়াবাতের স্ত্রীকে তস্কর চক্র আরো হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে এবং জাতীয় যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণিকে। বঙ্গবন্ধুর আহবানে তাকে রক্ষা করতে এলে ৩২ নম্বর রোডের মুখে ঘাতক চক্র আরো হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর এককালীন সামরিক সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল জামিলকে। এই কালোরাতে শেখ হাসিনার একমাত্র বোন শেখ রেহানা ব্যতীত পরিবারের সকল সদস্যকে হারান। তিনি ও তাঁর বোন শেখ রেহানা ঐসময় পড়াশোনার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন।
১৯৮১ সালে এক দুঃসময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সর্বসম্মতিক্রমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আরোহনকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অবৈধ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সামরিক শাসক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে এই সামরিক শাসকের অধীনেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সামরিক শাসক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গগণ নিলজ্জভাবে সুকৌশলে ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুনিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠনের সহায়তায় এরশাদ বিরোধী দূর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে অভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
আওয়ামী বিরোধী চক্র ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সূক্ষ কারচুপির মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুনিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের তৎকালীন বৃহত্তম বিরোধীদল হিসেবে প্রকাশ পায়। তিনি মহান সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভ করে । ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রথমবারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, ঢাকায় এক জনসভায় বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকারের সন্ত্রাস, নির্যাতন, অত্যাচার, জেল-জুলুমের প্রতিবাদে সন্ত্রাস বিরোধী সভায় বক্তৃতাদানকালে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। উক্ত হামলায় তাঁর দেহরক্ষী , আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ১৯ জন মৃত্যুবরণ করেন ও শতাধিক নেতাকর্মী মারত্মকভাবে আহত হন। যাঁরা আজো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এই হামলাকে বিদেশী ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়। তৎকালীন চারদলীয় বিএনপি-জামাত ঐক্যজোট সরকার ও তাদের তাবেদার প্রশাসন এই গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটকসহ বেশকিছু প্রহসন সৃষ্টি করেছিল । পরবর্তীতে দেশী ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (বর্তমানে বাংলাদেশে বিলুপ্ত) নেতা মুফতি হান্নানসহ তৎকালীন বিএনপি-জামতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন ২০০৭ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সকাল ৭:৩১-এ যৌথ বাহিনী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাসভবন “সুধা সদন” থেকে গ্রেফতার করে। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেখানে আদালত তার জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনকে সাব-জেল হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তরীণ রাখা হয়। গ্রেফতারের পূর্বে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে যান। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইটি অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। একটি হল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্য হত্যা মামলা এবং অন্যটি হল প্রায় তিন কোটি টাকার চাঁদাবাজি মামলা। এর মাঝে একটির বাদী ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটি তুলে নেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পরে তিনি চিকিৎসার্থে কয়েক মাস বিদেশে অবস্থান করেন। এরপর দেশে ফিরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তাঁর আওয়ামী লীগ ও দেশের জনগণকে প্রস্তুত করেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। করেন। তাঁর দল আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে ২৬০টি আসন লাভ করে আবারও ক্ষমতায় আসে। বিজয়ী দলের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ ২য় বারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মহাজোট নেত্রী হিসাবে তিনি নির্বাচনের পূর্বে রূপকল্প ভিশন ২০২১ ঘোষণা দেন।
১৮ নভেম্বর, ২০১৩ নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাজোট এর প্রার্থীগণ বিজয়ী হন। ৫ জানুয়ারি রোববার বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাকী ১৪৬টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ওই নির্বাচনের কোনই বিকল্প ছিল না। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে তিনি ঘোষণা দেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করবেন।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতে, ‘ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দুঃসময় কাটিয়ে আবারও জেগে উঠেছে । এই জেগে ওঠার রহস্যটা কী? বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্তের শ্রেণী চরিত্র আওয়ামী লীগেও বর্তমান। এই মধ্যবিত্তের ভালো-মন্দ, সুবিধাবাদিতা, আপস-সংগ্রাম সবই আছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক চরিত্রে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি খুঁটির জোরে বেঁচে গেছে। এই খুঁটিটি হলো তার জন্মসূত্রে পাওয়া সংগ্রামের নীতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা ও আদর্শ। ১৯৮১ সালে শরণার্থী জীবন থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন আবার এই নীতির খুঁটি জড়িয়ে ধরেছেন, তখনই আওয়ামী লীগ আবার জেগে উঠেছে ‘। সব বাধা উপেক্ষা করে ও জীবনবাজি রেখে তিনি নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন । তাঁর এই ফিরে আসাটা ছিল গণতন্ত্রের মুক্তি, দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির নবস্বপ্ন।
`আওয়ামী লীগ এখন আর একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম নয়। এখন একটি আদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক পার্টি। বাংলাদেশে জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাসের মুখে গণতন্ত্রের নিবুনিবু বাতি আগলে আছেন। তাঁর দূরদর্শী ও সুযোগ্য নেতৃত্বে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি, স্খলন-পতন সত্ত্বেও এখনও গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের ঘাঁটি আওয়ামী লীগ আগলে আছে। এটা শুধু উপমহাদেশে নয়, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় একুশ শতকের একটি স্মরণীয় বড় ঘটনা ‘।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘‘আপনার সাহসী নেতৃত্ব বাংলাদেশের জনগণকে কঠিন সময়েও আশার আলো দেখিয়েছে।’’ উন্নয়ন থেকে নিরাপত্তা সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও মোদিজি জানান ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৭৫-এর পর পদে পদে অন্ধকারের সরীসৃপ এবং মৃত্যু-ঝুঁকি মোকাবিলা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অভাব-অনটন ক্ষুধার রাজ্যে সফল নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র মুক্ত এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে এনেছেন যা আজ বহু রাষ্ট্রনেতা বহু দেশের কাছে ঈর্ষণীয়। বলা যায়, শেখ হাসিনা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন দূরদর্শী রাজনীতি দিয়ে কিভাবে একটি দরিদ্র দেশকে সমৃদ্ধির মহাসড়কে তুলে আনা যায়। নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহিয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম শামসুন নাহার মাহামুদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয়া বেগম সুফিয়া কামালের সারিতে শেখ হাসিনার নাম এখন দিবালোকের সূর্যের মত জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে ।
এ মুহূর্তে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১০/১১ কোটি সেল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে, ডেক্সটপ ও লেপটপ পিসি সহজলভ্য হওয়ায় এখন তা বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাফল্যজনকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে শেখ হাসিনার সরকার। অবকাঠামো ও রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখছে। বিদ্যুতায়নের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আজ যে কোনো সময় ও কালের চেয়ে বেশি প্রাণচাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছে।
১২ বছর আগে যে উত্তরবঙ্গ ছিল ভয়াবহ মঙ্গা কবলিত, সেখানে ‘মঙ্গা’ শব্দটিই আজ হারিয়ে গেছে। মানুষ দু’ বেলা পেটপুরে খেতে পারছে, আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারছে। আমাদের কৃষি ও মৎস্য গবেষক ও বিজ্ঞানীগণ আমাদের বিলুপ্রাপ্ত কৃষিপণ্য এবং মৎস্য পুনরুদ্বার বা গবেষণায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চলেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ রক্তপাত নেই, বরং কমলা, আঙ্গুর, আপেল, মাল্টা, স্ট্র-বেরী প্রভৃতি বিদেশী ও আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা প্রভৃতি দেশীয় ফলও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন ও বাজারজাত হচ্ছে। টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রসারের সুফল হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের পোশাক-আশাকেও অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। এসব কিছুর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার।
নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়ে বিচার করেন চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর নেতাদের। যদিও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের যারা একসময় মন্ত্রী-এমপি ছিলেন, তাদের বিচারকে প্রভাবিত করতে দেশ ও বহির্বিশ্বের নানা চাপ ছিল। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতা হত্যার বিচার এবং ৩৮ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের শহীদানের ঋণ পরিশোধ ও জাতির আশা আকাংখা অনুযায়ী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান ও অপরাধীদের শাস্তি প্রদানেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে যেভাবে সাহসিকতার সাথে জেএমবি, আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, মুসলিম ব্রাদারহুড, তালেবানদের এজেন্ট জামাত-শিবির, হিযবুত তাহরীর হিযবুল মুজাহিদিন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামযা ব্রিগেড-এর মত জঙ্গিদের মোকাবিলা করে চলেছেন, তা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়। প্রাকৃতিক: বন্যা, খরা, টর্নেডো, শৈত্যপ্রবাহ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা জলবায়ু পরিবর্তনে বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিকাণ্ডে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো; আগুনের ছাই থেকে উঠে এসেও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশকে। অথচ এ দেশেই একদিন আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন বাবা-মা, ভাই-ভাবীসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। নিজেও হামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকবার। এত কিছুর পরও মাটিকে ভালোবেসে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে পথ চলছেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন অনুকরণীয় নেতৃত্ব। খাদ্যনিরাপত্তা, শান্তিচুক্তি, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, সীমান্ত বিজয়, সমুদ্র বিজয়, নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মহাকাশ বিজয়, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মান, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি, স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় সমুজ্জ্বল তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ দক্ষতায়, মেধায়, প্রজ্ঞায়, মননে, দূরদর্শীতায় সবাইকে পেছনে ফেলে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ধরিত্রীর আদরের কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি আজ বিশ্বে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত। ১৯৭১, ১৯৭৫ , ২০০৪ ও ২০১৩-এর ঘাতকরা পরাভূত। ঘাতকরা ১৯ বার তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করে, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপা যে, তিনি তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়ক, মধ্যম আয়ের দেশ-এর শীর্ষ কাতারে নিয়ে যেতে শক্তি যুগিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি নিরন্তন চেষ্টা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনও করেছেন। দেশ আজ কৃষিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ । বিদ্যুৎ উৎপাদন সাফল্য ঈর্ষনীয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও সম্মান বৃদ্ধি, বয়স্ক,বিধবা, প্রতিবন্ধি ভাতার সংখ্যা ও পরিমাণ বৃদ্ধি, শহরের বস্তিবাসীদের ঘরে (গ্রামে) ফেরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু, কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চালুর মাধ্যমে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা প্রভৃতি এক মহা যুগান্তকারী কার্যক্রম । অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে একটি রোলমডেল।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনেও তিনি বিশ্বনেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। শেষ করেছেন জাতির জনকের হত্যা মামলা মামলা । যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। তার দৃঢ় নেতৃত্বে আজ বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল পরিণত হয়েছে। বিশ্বে যে পাঁচটি দেশ দ্রুত উন্নয়ন করছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব উন্নয়ন ও শান্তি প্রচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেত্রী। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময় । তিনি দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলছেন অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি চুক্তি। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি । শেখ হাসিনার আমলেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকেই দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো।
২০০৯ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য হেগের সালিশি আদালতে নোটিশ করে। এর পথ ধরেই ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার রায় পায়। এতে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপান এলাকায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার চলতি মেয়াদে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি কার্যকর করায় দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হয়। ৬৮ বছর পর নাগরিক হিসেবে পরিচয় পায় ছিটমহলবাসী। পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার হতে নতুন করে অন্যায় ও নিষ্ঠুরভাবে বিতাড়িত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান করে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে এখন মানবতার জননী।
নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন শেখ হাসিনা। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা তাকে সম্মাননা দিয়েছে। চলতি বছর (২০১৮ সালে) পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি-লিট) ডিগ্রি প্রদান করে। নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য একই বছর পেয়েছেন ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের টেলিভিশন ‘চ্যানেল ফোর’ তাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ আখ্যা দেয়, দুবাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম খালিজ টাইমস আখ্যা দিয়েছে ‘স্টার অব দি ইস্ট’। তাঁরই প্রচেষ্টায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনোস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ বাঙালি জাতির মহান বিজয়। ২০১৬ সালে শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ পুরস্কার’ ও ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পুরস্কার প্রদান করে জাতিসংঘ। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ৭০তম অধিবেশনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরষ্কার-২০১৫ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য পান ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’। রাজনীতিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের জন্য পান ওম্যান ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড। নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের জন্য তিনি সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ করেন ৷ ২০১৪ সালে শেখ হাসিনাকে ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’ পুরস্কারে ভূষিত করে ইউনেস্কো। ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের জন্য তিনি জাতিসংঘ কর্তৃক সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ করেন ৷
পাশাপাশি শেখ হাসিনা তার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কারণে বিভিন্ন স্বীকৃতিও অর্জন করেছেন। এর মধ্যে বিশ্বখ্যাত ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে বিশ্বের ক্ষমতাধর শত নারীর তালিকায় ৩৬তম এবং নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর জরিপে ২০১১ সালে বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী নারী নেতাদের তালিকায় সপ্তম স্থান দখল করেন। ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১ সালে শেখ হাসিনাকে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলা একাডেমি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। এছাড়াও, ১২ জানুয়ারি, ২০১২ তারিখে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি এবং উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করে। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন অবদানের জন্য ‘মান্থন অ্যাওয়ার্ড’, ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’, ‘কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’, ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘের ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড’, ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক-২০০৯’, ‘পার্ল এস বাক পদক’, ‘ডক্টরস অব হিউম্যান লেটার্স’, ‘সেরেস পদক’, ‘মাদার তেরেসা পদক’, ইউনেস্কোর ‘ফেলিং হুফে বইনি শান্তি পুরস্কার’, ‘নেতাজি মেমোরিয়াল পদক-১৯৯৭’সহ বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ও সম্মাননা পেয়েছেন।
৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না আসলে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের মতই ব্যর্থ জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হত। চারিদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হায়নার গ্রাস করতো সব সুন্দরকে। হয়ত এতদিন পাল্টে ফেলতো এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত। বন্ধ হত নারী শিক্ষা । দেশ এগিয়ে চলতো মধ্যযুগের সেই বর্বতার দিকে।
প্রায় চার দশকের মতো সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের মতো আলো ছড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। মানবতার জননী, নির্লোভী, আপোষহীন, তেজী, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন এই নেত্রী সংগ্রাম করেই আজ বিচক্ষণ এক রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। তার দিকেই তাকিয়ে থাকে সারা জাতি। তিনি জাতির শেষ ভরসার স্থল । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তিনিও হতে চলেছেন তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, মেহনতি মজলুম জনগণের বন্ধু মানবতার জননী। আজ শেখ হাসিনা হাসলেই বাংলাদেশ হাসে। তিনিই আমাদের পরম শ্রদ্ধা আর ভরসার আশ্রয়স্থল। আজ তাঁর জন্মদিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক:
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম
পরিচালক, এফবিসিসিআই।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ