প্রকাশ: শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৪:২৬ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
ব্রুনাইয়ে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা শেখ আমিনুর রহমান হিমুর পড়ালেখা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে পরিচিত সবাই তাকে জানতেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে। কারণ নিজেকে সে অক্সফোর্ড থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী হিসেবেই পরিচয় দিত। ব্রুনাইয়ের সুলতানের মেয়ে অক্সফোর্ডে তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বলেও দাবি করত। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কৌশলে তোলা ছবি ব্যবহার করে নিজেকে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচয় দিত হিমু। এই পরিচয়ে সে ২৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ এক চিকিৎসককে বিয়েও করে। নানারকম ছদ্মপরিচয় ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে হিমু প্রতারণা করেছে বহু মানুষের সঙ্গে। ব্রুনাইয়ে চাকরি দেওয়ার নামেই সে হাতিয়ে নেয় অন্তত ৩৩ কোটি টাকা। টানা দুই মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারের পর হিমুকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাফরুল থেকে হিমুকে গ্রেপ্তার করে এনএসআই ও র্যাব -৩-এর যৌথ দল। তার কাছে পাওয়া যায় একটি বিদেশি পিস্তল ও দুটি ম্যাগাজিন। পরে মহাখালীর ডিওএইচএস থেকে তার দুই সহযোগী নূর আলম ও বাবলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, হিমু যেন আরেক সাহেদ করিম। রিজেন্টকাণ্ডে আলোচিত সাহেদের মতো সেও গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে অংশ নিয়ে নানারকম বক্তব্য দিত।
র্যাব -৩-এর অপারেশন অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস বলেন, ভুয়া পরিচয় ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে শেখ আমিনুর রহমান হিমু। অনেক ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তারা মাথাপিছু আড়াই-তিন লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। হিমুর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও প্রতারণার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে।
র্যাব সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নড়াইল-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে কিছু পোস্টার ছাপায় হিমু। সেগুলো এলাকার বিভিন্ন দেওয়ালে সাঁটিয়ে নিজেকে হবু এমপি হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করে। পরে মনোনয়ন না পেলেও এমপি হিসেবে পরিচয় দেওয়া অব্যাহত থাকে। কোথাও এমপি, আবার কোথাও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে নিজেকে জাহির করত সে। ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার পরিচয় লেখা আছে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী। বিভিন্ন দিবসে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে তৈরি পোস্টারের নকশাও রয়েছে তার ফেসবুক পোস্টে। ২০১৮ সালে সে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১০ লাখ টাকা দেয়। সেই ছবিটি পরে তার প্রতারণার একটি হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ফেসবুকে তার বন্ধু তালিকায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা যায়। সুরাইয়া গ্রুপ অব কোম্পানি নামে বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ে কথিত প্রতিষ্ঠান খোলে হিমু। নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। মূলত মানব পাচারসহ নানাবিধ প্রতারাণায় এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হতো।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, ব্রুনাইয়ের সুলতানের মেয়েকে নিজের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে রাজপ্রাসাদেই অনেকের চাকরি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল হিমু। এ ছাড়া দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আরও অনেক চাকরির সুযোগ রয়েছে বলেও প্রতারিতদের সে জানায়। এভাবে সে ৪০০ জনের কাছ থেকে টাকা নেয়। তবে ৫০ জনকে পাঠানোর পরই ঝামেলা দেখা দেয়। দেশটির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে জানান, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এখান থেকে লোক পাঠানো হচ্ছে। তখন থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধান। আসলে হিমুর কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্সই নেই। সে মানব পাচার চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজন ও আবদুল্লাহ আল মামুন অপুর সহযোগী হিসেবে কাজ করত। সে বিজনের কোম্পানির নামে ভুয়া ডিমান্ড লেটার সংগ্রহ করে নজরুলের রিক্রুটিং লাইসেন্স ব্যবহার করে লোকজনকে ব্রুনাইয়ে পাঠাত। তবে সেখানে গিয়ে তারা কোনো চাকরি পাননি। অবৈধভাবে যাওয়ায় তাদের ঠাঁই হয় দেশটির কারাগারে। সেখানকার পুলিশ পাসপোর্ট চাইলেও তারা দেখাতে পারেননি। কারণ হিমুর চক্র পাসপোর্ট নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। কারাবন্দিরা বিভিন্ন মাধ্যমে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা নেয় চক্রের সদস্যরা। অনেক দুর্ভোগ সহ্য করে ওই বাংলাদেশিরা পরে দেশে ফিরে আসেন।
সংশ্নিষ্টরা জানান, হিমু প্রায় ১০ বছর ইতালিতে ছিল। সেও অবৈধভাবে মানব পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে বুলগেরিয়া হয়ে ভেঙে ভেঙে সেখানে পৌঁছায়। একপর্যায়ে সে নিজেও পাচারকারী চক্রে জড়িয়ে পড়ে। তার পার্টনারদের মধ্যে বিজন এখন দেশের ভেতরেই পলাতক আছে। আর অপু কম্বোডিয়ায় আছে বলে জানা গেছে। মহাখালী ডিওএইচএস এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় ও পঞ্চম তলা মিলে হিমুর অফিস। তেমন কোনো কাজ না থাকলেও প্রতি মাসে ওই অফিসের ভাড়া দিতে হয় চার লাখ টাকা।