তাছাড়া, হাসান আসকার রিজভি বলেন, আফগানিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তালেবানের একটি অংশ যেভাবে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, পাকিস্তানের মধ্যে তা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে।
"পাকিস্তান হয়ত এখন পুরোপুরি একটি তালেবান সরকারও চায় না।"
তিনি বলেন, পাকিস্তানের মধ্যে একটি আশঙ্কা এখন কাজ করছে যে আফগানিস্তানে তালেবান যদি পূর্ণ ক্ষমতায় চড়ে বসে তাহলে একসময় পাকিস্তানের জন্য তা হুমকি তৈরি করতে পারে।
তেহরিকে তালেবানের (টিটিপি) মত পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর সাথে হয়ত আফগান তালেবানের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতে পারে। জাতিসংঘের এক হিসাবে কমপক্ষে ৬০০০ পাকিস্তানি তালেবান এখন আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে শামিল রয়েছে।
কিন্তু তারপরও পাকিস্তান মনে করছে, আফগানিস্তানে ক্ষমতায় তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ তাদের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
কিন্তু আফগানিস্তানে আবারো একটি তালেবান সরকার, এবং তাদের নেতৃত্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ভারতের কাছে দুঃস্বপ্নের মত।
ভারত কেন এত উদ্বিগ্ন
দিল্লিতে জওহারলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ( জেএনইউ) দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বিবিসিকে বলেন, "তালেবান যদি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে, তাহলে ভারত এবং আফগানিস্তানের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়বে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।"
কারণ, অধ্যাপক ভরদোয়াজ মনে করেন, তালেবান, ভারতবিরোধী কট্টর ইসলামপন্থীদের সমর্থন করেছে, এবং সে কারণেই ভারত সবসময় চেয়েছে শান্তি আলোচনা যেন আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে হয়।
শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, আফগানিস্তানের মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্য এবং চীন ও পাকিস্তানের সাথে রেষারেষিতে ভারসাম্যের জন্য ভারতের কাছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব অনেক। আফগানিস্তানের উত্তরে ইরান ছাড়াও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। পূর্বে পাকিস্তান, এবং ইরান-পাকিস্তান পেরিয়ে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ কারণে গত এক দশকে আফগানিস্তানের অর্থনীতি, নিরাপত্তা, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে ভারত তাদের ভূমিকা বাড়িয়েই চলেছে। সামাজিক অবকাঠামো এবং রাস্তা-ঘাট সেতু, বাঁধ ইত্যাদি প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি ডলার যা যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া, ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তথ্যমতে, আফগান ব্যাংকিং, তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য খাতে ১৭০০ ভারতীয় কাজ করছে। অনেক ভারতীয় কোম্পানি সেদেশে অফিস খুলে ব্যবসা করছে। আর সে কারণেই আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ভবিষ্যতের রদবদল নিয়ে ভারত চিন্তিত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দোহার সভায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনলাইনে অংশ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। ভারতের একজন কূটনীতিক (জেপি সিং) দোহায় গিয়ে হাজির হয়েছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ হানি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্রমাগত দেন-দরবার করছে ভারত।
ভারতের তালেবান সমস্যা
ভারত কোনোভাবেই চাইছে না আফগানিস্তানে তালেবানের প্রভাব এমন হোক যাতে দেশটি আবার কট্টর একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভারত জানে তালেবানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, এবং ভারতকে নিয়ে তালেবানের কোনো আগ্রহ নেই।
তবে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক সজ্জনহার বলেন, তালেবান এখন আর আগের মত কট্টর ইসলামী সংগঠন নেই, এবং ভারতের ব্যাপারে তাদের মনোভাবেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নভেম্বরে যখন রাশিয়া তালেবানের কজন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানায়. তখনও পর্যবেক্ষক হিসাবে সেখানে দুজন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিকের উপস্থিতি তালেবান মেনে নিয়েছিল।
"১৯৯০ এর দশকের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়। তারা ইসলামী রাষ্ট্র চায়, কিন্তু একইসাথে সেখানে সবার অংশগ্রহণে তাদের ততটা আপত্তি এখন আর নেই। তারা জানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি তাদের প্রয়োজন।"
তাছাড়া, মি. সজ্জনহার মনে করেন, সাধারণ আফগান জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি মনোভাব ইতিবাচক। "তারা জানে ভারত যেভাবে তাদের সাহায্য করছে সেটা আর কেউ করবে না। ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন, এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবে না।"
তবে শুধু তালেবান বা পাকিস্তান নয়, আফগানিস্তানের ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের আগ্রহ যেভাবে বাড়ছে সেটাও ভারতের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ। চীন সম্প্রতি আফগানিস্তানের তামা এবং লোহার খনিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। চীন ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে তালেবানের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে পারে- এই আশঙ্কাও ভারতের মধ্যে রয়েছে।
দোহার বৈঠকে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে মীমাংসা হবেই, তা একশ ভাগ নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব । অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, মার্কিন নির্বাচনের আগে হয়তো একটি লোক দেখানো নাটক হচ্ছে।
কিন্তু আমেরিকা আজ হোক কাল হোক সৈন্য প্রত্যাহার করবেই, এবং তখন যে আফগানিস্তান অনেকটাই বদলে যাবে তা নিয়ে কারোরই তেমন সন্দেহ নেই। সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। সূত্র: বিবিসি বাংলা