সংবাদপত্র থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের যুগে অনলাইন নিউজপোর্টাল যুক্ত হওয়া- এক কথায় পুরো গণমাধ্যম অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। শেষ দফা করোনাকালের পৃথিবীময় অর্থনীতির মহাবিপর্যয় গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জকে কঠিনই করেনি অস্তিত্ব রক্ষার বা টিকে থাকার যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। করোনার আগেই পশ্চিমা দুনিয়ায় মূলধারার প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্র প্রবল ঝাঁকুনি খেয়েছে অনলাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে পাঠকের ইন্টারনেটে সংবাদপত্র পাঠ করার সুবাদে। এমনকি একসময় লন্ডন নিউইয়র্কে আমাদের প্রবাসীদের জন্য যে দৈনিক সাপ্তাহিক বিমানে উড়ে সপ্তাহে একাধিকবার যেত তাও বন্ধ যখন ইন্টারনেটে তারা দেশের সংবাদপত্র পাঠকের হাতে যাওয়ার আগেই পড়ার সুযোগ পান।
এমনকি বাংলা সাপ্তাহিকগুলো একসময় দাপটে চললেও কালের যাত্রাপথে মুখ থুবড়ে পড়েছে। লোকসানের মুখে ফ্রি দিয়েও পাঠক টানছে না। যাক, মূলধারার সংবাদপত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল ৫০ বছর পর পৃথিবীতে প্রিন্ট মিডিয়া থাকবে না, যুক্তরাজ্য বলেছিল পাঁচ বছর পর তাদের প্রিন্ট মিডিয়া বন্ধ হবে। অনেক প্রভাবশালী দৈনিক প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করেছে। মিডিয়া মোগল খ্যাত রুপার্ট মার্গটকেও সে ধাক্কা খেতে হয়েছে। বন্ধ ও ছাঁটাইয়ে যেতে হয়েছে। অনেক সংবাদপত্র সার্কুলেশন বিপর্যয় দেখেছে।
এমনকি বইয়ের বাজারেও পাঠক মন্দাভাব দেখা দেয় ইন্টারনেটে স্বল্পমূল্যে বই ডাউনলোড করে পাঠের সুবাদে। যদিও প্রিন্ট ভার্সনেই আবার ফিরতে দেখা গেছে পশ্চিমা বই-পাগলদের। আমাদের দেশেও অনেকে বলছেন সংবাদপত্রের দিন শেষ হয়ে আসছে, সামনে অনলাইনের যুগ। কিন্তু তার আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। কয়েক প্রজন্ম এখনো সংবাদপত্রের প্রতিই আসক্ত। নিউজপোর্টালের নিউজ পড়ে, টিভির খবর দেখেও কাগজেই পুরোটা পড়ার তৃপ্তি। বিজ্ঞাপনদাতারাও অনলাইন নন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ই বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী। পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
যাক, সংবাদপত্র বন্ধ বা কর্মী ছাঁটাই পশ্চিম থেকে যে ঢেউ তুলেছিল এ উপমহাদেশেও তা লেগেছে। ভারতের আনন্দ পাবলিশার্সও চাকরিচ্যুত করার কাজে হাত দেয় বেশ আগেই। করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার সম্পাদকের পদত্যাগ সেই ভয়াবহতা উন্মোচিত করেছে। করোনাকালে পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে। কত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ায় বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হননি সরকারও ঘর্মাক্ত হয়েছে। কত প্রতিষ্ঠান দেশে দেশে বন্ধ। কত শপিং মলে তালা ঝুলেছে। অর্থনৈতিকভাবে ধনাঢ্য দেশও এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লড়াইয়ে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের করোনাযুদ্ধের পাশাপাশি জীবন-জীবিকার লড়াই অব্যাহত রাখার নীতিটা যে দূরদর্শী ছিল তা এখন উপলব্ধি করা যাচ্ছে। দেশের বৃহৎ শিল্প ও গণমাধ্যম পরিবারের আইকন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানও এ নীতিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে সব বাংলা, ইংরেজি সংবাদপত্র, নিউজপোর্টাল, টিভি চ্যানেলকে কাজে লাগিয়েছেন। দেশপ্রেমিক শিল্পপতি হিসেবে, দেশের অর্থনীতি বাঁচানোর নীতিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। সঙ্গে করোনার যুদ্ধেও ভূমিকা রেখেছেন। ট্রান্সকম গ্রুপের বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক, ঐতিহ্যবাহী ইত্তেফাক থেকে প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলোও সাহসী ভূমিকা রেখেছে প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে। করোনাকালের লকডাউনের শুরুর কঠিন দুঃসময়ে পাঠকরা ছোঁয়াচে করোনার ভয়ে পত্রিকা স্পর্শ করতে নারাজ ছিলেন।
বাসাবাড়িতে অনেকে হকারদের মানা করেছিলেন। অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। হকাররাও পত্রিকা বিতরণে রাজি ছিলেন না। বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। এমনি দুঃসময়ে লোকসান গুনে, হকারদের সাহসের প্রণোদনায় ধরে রেখে, সেবা খাতের শিল্প সংবাদপত্রের প্রকাশনা অব্যাহত না রাখলে গণমাধ্যম এভাবে ঘুরে দাঁড়ানো দূরে থাক চরমভাবে হোঁচট খেত। এ দেশের সংবাদপত্রের জন্য এ কঠিন সময় বড় চ্যালেঞ্জের। যুদ্ধেও মানুষ সংবাদপত্রে তুমুল আগ্রহী কিন্তু করোনাকালে ছিল ভয়ে ভীত। টিভি ও অনলাইন সংবাদনির্ভর হলেও কিন্তু সংবাদপত্রের প্রিন্ট ভার্সনের তৃষ্ণা কোনো মাধ্যমই এখনো মেটাতে পারে না। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপর্যয়কালে সংবাদপত্রশিল্পের ওপর এমন আঘাত ছিল আচমকা, অজানা ও অসহনীয়।
এ সময় অনেক সংবাদপত্র প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়েও যেতে বাধ্য হয়। যাদের সার্কুলেশন হাতের আঙ্গুলে গোনা যায় তাদের জন্য যত ভয়ের তার চেয়ে ব্যয়বহুল ও পাঠকপ্রিয় দৈনিকগুলোর জন্য ছিল ভীতিকর যুদ্ধের। এখনো সংবাদপত্রশিল্প কঠিন ঝুঁঁকি থেকে বের হতে পারছে না। সরকার দেশের সবার জন্য প্রণোদনা দিলেও সংবাদপত্রের জন্য দেয়নি। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা বকেয়া বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধেও আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আকুতি, দৌড়ঝাঁপ নিয়ত দেখা যাচ্ছে। একটি রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের নাম আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ।
সেখানে পশ্চিমা গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বা ফোর্থ এস্টেট হিসেবে সংবাদপ্রত্র বা গণমাধ্যম পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়াসহ আমাদের দেশেও ফোর্থ এস্টেটের বড় রুগ্নদশা। সেলফ সেন্সরশিপ ছাড়াও রাষ্ট্রযন্ত্রের নানামুখী হাত আর পেশাদারিত্বের বদলে গণমাধ্যমের মোড়লদের নির্লজ্জ দলবাজি, অপেশাদারদের দৌরাত্ম্য পরিস্থিতিকে নাজুক করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গে এখানেও মামলায় হয়রানি থেকে সাংবাদিকদের যেতে হচ্ছে জেলে।
সাইবার অপরাধীদের চেয়ে সংবাদকর্মীরাই বেশি নিপীড়নের শিকার। এ নিয়ে সম্পাদক পরিষদ উদ্বিগ্ন হলেও, সংশোধন চাইলেও মতলববাজ আখের গোছানো মোড়লরা নীরব। দলকানা দলদাস বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই অপেশাদার ও দুই দলের মাঠের কর্মীর ভূমিকায়। সাংবাদিক নিপীড়ন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। পরিচয় ও পরিচয়হীন এদের বেশির ভাগই দল করে খায়। গণমাধ্যমের দুঃসময়ে এদের কোনো অবদান নেই। আছে সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের বদলে দল বেচে জীবিকা নির্বাহ করা। জাতীয় প্রেস ক্লাবেও দলীয় ভাগাভাগিতে সদস্যের নামে যারে খুশি ভোটার বানানোর অমর্যাদার ঘটনা বহু বছর ধরে চলছে। আওয়ামী ফোরামে সভাপতিত্ব করেন সরকারি দলের এমপি। সংসদে পেশার দুর্ভোগের কথা বলেন না।
বিএনপি ফোরামের নেতা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। মানমর্যাদা বলে পেশার কিছু নেই। অনেকে বলবেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থেকে জহুর চৌধুরী, নির্মল সেন থেকে এ বি এম মূসাও রাজনীতি করেছেন। তাঁরা পেশাদারিত্বের চরিত্র সাহস মর্যাদা ব্যক্তিস্বার্থে ধুলোয় লুটিয়ে দেননি, বুক দিয়ে আগলেছেন। জেলে গেছেন। একালের বিভক্ত দুই সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফোরামের প্রতি সবিনয় নিবেদন- গণমাধ্যমকে মুক্তি দিয়ে দুই দলের অঙ্গসংগঠন হয়ে যান। আপনাদের দলবাজি রাজনীতির পথে করুন।
দল ও আপনারা উভয়ে লাভবান হবেন। আমাদের মুক্তি দিন। প্রতিষ্ঠানে বা পেশায় মনোযোগ না দিয়ে যেসব গণমাধ্যম মোড়ল দিনভর তদবির, বাণিজ্য করেন, ব্যবসা করেন, তাদেরসহ দলকানাদের কাছে নিবেদন- দল ও বাণিজ্য করলে সাংবাদিকতা ছাড়–ন, সাংবাদিকতা করলে দল ও বাণিজ্য ছাড়–ন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে এ দেশে ১৪ জন সাংবাদিক খুন হন। পরের সরকারে খুন কম হলেও নিপীড়ন কমেনি। কাজলরা মুক্তি পান না। সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের রহস্য খোলে না। রাজনীতিবিদসহ সবার সমালোচনা করে টকশোয় গলাবাজির আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন।
দেখবেন কতটা নামিয়েছেন পেশাদারিত্বকে। রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, ব্যবসায়ীসহ সবার সমালোচনা করি আমরা। আত্মসমালোচনা কখনো করি না। নিজেদের সংশোধনের পথে নিই না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নবায়নে পেশাদার জরিপ সংস্থা দিয়ে পাঠক-দর্শকদের মতামত নিই না। সায়মন ড্রিং একুশে টিভির মাধ্যমে যে ধারা চালু করেছিলেন তা ভেঙে টিভি চ্যানেল নতুন ধারায় বের হয়ে আসতে পারেনি। দুস্থ সাংবাদিকদের সরকার অনেক টাকা দিয়েছে, ভালো কথা দিন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, রাবিশ! শত শত দৈনিক ঢাকায় কোথায়? ২০-২৫টির বেশি দৈনিক দেখি না। যথার্থই বলেছিলেন।
তখন পাশে ছিলেন সেদিনের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ওয়েজবোর্ড অনুসরণ করা পেশাদার সাংবাদিকদের বহুল প্রচারিত দৈনিকের সঙ্গে কোথাও না দেখা, নাম না জানা দৈনিকের নামে সমান রেটে সরকারি বিজ্ঞাপন কেন দেওয়া হবে? যে দৈনিক পাঠকের হাতে নেই সেখানে কেন বিজ্ঞাপন যাবে? যে দৈনিক মাসের পর মাস বেতন দিতে পারে না তাদের ঊর্ধ্বতনরাও মোড়লের মতো চলেন। আরেক দল খোঁজেন রাজনৈতিক নিয়োগ। গণমাধ্যম-বিচ্ছিন্ন কেরানির জীবন। একসময় সাংবাদিক মানেই গরিব- এমনটা ছিল। ওয়েজবোর্ড আর শিল্পপতিরা এসে মোটা পুঁজি বিনিয়োগ করলে আসে সচ্ছলতা। কিন্তু অনেকের ইবাদত নিয়ে কাজ করার মন নেই।
পেশাদারিত্বকে নিলামে তোলে এই অযোগ্যরা। সব মিলিয়েই আয়নার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় আজ সংবাদকর্মীদের। হিসাব মেলানোর সময়। অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়। জনগণ যে কাগজের নাম জানে না, পাঠ করার সুযোগ পায় না, চোখেও দেখে না সেখানে বিজ্ঞাপন অপচয়। আর যারা সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়েননি, গড়ার ইচ্ছা-যোগ্যতা নেই তারা যে কোনো পেশায় যান, এখানে ইজ্জতটার কবর দিচ্ছেন কেন? জনগণের জন্য ভূমিকা রাখার পাঠকপ্রিয় দৈনিক রেখে, সার্কুলেশন নেই এমন কাগজে কেন যাবে সরকারি বিজ্ঞাপন, ক্রোড়পত্র? এ প্রক্রিয়া কখনো কাজে আসে না। তার চেয়ে ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দৈনিককে বিজ্ঞাপন দিন।
আন্ডারগ্রাউন্ড বা পাঠকহীন, ঐতিহ্যহীন সংবাদপত্রকে নয়। বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল পরিশোধেও সরকারকে পাঠপ্রিয়তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এবং জাতির পিতার নেতৃত্বে সেই মহাজাগরণে সংবাদপত্রের যে সাহসী ভূমিকা, গণতান্ত্রিক সব সংগ্রামে যে অবদান তা ইতিহাসে অমর। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মিডিয়াবান্ধব। সংবাদপত্র একদিন বন্ধ থাকলে তিনি বলেন, আলুনি আসে। তাঁর শাসনামলে সংবাদপত্রের চলমান ক্রান্তিকাল আলোচনার মাধ্যমে কাটিয়ে ওটা সম্ভব। সম্পাদকরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তথ্যমন্ত্রী নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের কোনো স্তম্ভই এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলে গণমাধ্যম বা স্বাধীন সাংবাদিকতা কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। জনগণ যেখানে রাষ্ট্রের মালিক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে সংবিধানস্বীকৃত, সেখানে সব তথ্য জানার অধিকারও প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। আর খবর হলো জনগণের সম্পদ। সাংবাদিকদের সেটি মানুষের কাছে পৌঁছানো ইমানি দায়িত্ব। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলা কোনো স্লোগান নয়, একটা নির্মোহ সত্য উচ্চারণের বিশ্বাস। গণমাধ্যম আইন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে যেমন নয়, তেমনি সরকার উৎখাতের বিপ্লবসহ নানামুখী উসকানিতে টানার সুযোগ নেই। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা শব্দটি এখানে বড় শক্তিশালী।
আবার গণমাধ্যমের কারও রক্ষিতার জায়গা নেওয়ারও সুযোগ নেই। মানুষের কাছেই তার সব দায়বদ্ধতা। এখন গণমাধ্যম নেগেটিভ নিউজকেই নয়, পজিটিভ নিউজকেও বড় করে তুলে আনে। উন্নয়নের চিত্র যেমন তুলে ধরে, সাফল্য যেমন চিত্রিত করে, তেমনি অসংগতি-দুর্নীতির খতিয়ানও দেয়।
আড়াই শ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস জেফারসন। তিনি সে দেশের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের একজন। সংবাদপত্র সম্পর্কে তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘আমাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার ও সরকারবিহীন সংবাদপত্র’ একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে দ্বিতীয়টি বেছে নিতে আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করব না।
জেফারসনের শিক্ষা ছিল, জনগণই সরকারের একমাত্র নিয়ন্ত্রক। সরকার কী করছে, তা জানার পূর্ণ অধিকার জনগণের রয়েছে এবং জনগণ তা প্রধানত জানবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। পৃথিবীর বহু গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধানরা এ কথার মর্ম এখনো বুঝতে চান না। এমনকি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের জন্য প্রতাপশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও দেখা যায় মিডিয়ার প্রতি তির্যক বাক্য ছুড়তে, বিবাদে জড়াতে এমনকি লাইভ প্রচার বন্ধ করে জেলে নিতে সাংবাদিককে। গণমাধ্যম বা মিডিয়া হাউসের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ এমন পর্যায়ে যায় যা আমাদের দেশেও দেখা যায় না।
সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা দুটো বিষয় যে কোনো রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়া রাষ্ট্র-সমাজ অচল। পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন যুদ্ধে, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এ ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানো থেকে শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সবখানে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল অন্যতম। বিশেষ করে এ ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। ১৭৮০ সালে জেমস হিকি নামে একজন ইংরেজ প্রথম ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এর প্রায় ৮০ বছর আগে ইংল্যান্ডে দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। ভারতবর্ষেও সাংবাদিকতার আগের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়।
সংবাদপত্রের ওপর দফায় দফায় সেন্সরশিপ আরোপ থেকে শুরু করে সংবাদপত্র বন্ধের ইতিহাসও কম নয়। আইরিশ বংশোদ্ভূত উইলিয়াম ডুয়ানে নামে একজন খ্যাতিমান মার্কিন সাংবাদিক একসময় কলকাতায় ছিলেন একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। সরকারবিরোধী ভূমিকার কারণে তাঁকে একসময় অপহরণ করা হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে তাঁর ওপর চলে নানা মানসিক নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাঁকে ভারত থেকে নির্বাসিত করে। ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ছিলেন জেমস সিল্ক বাকিংহাম। একসময় চাকরি করতেন জাহাজে। তিনি জাহাজের চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন।
ভারতে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করে তিনি শুরু করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা অনিয়ম-গোমর একের পর এক ফাঁস করতে থাকলে রোষানলে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে কয়েকবার দ্বীপান্তরে যেতে হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার লর্ড হেস্টিং তাঁকে রক্ষার জন্য এগিয়ে না এলে হয়তো মেরেই ফেলা হতো।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কোনো সময় নিরাপদ ছিল না। একুশ শতকে এসেও সাংবাদিকদের অনেকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। সবচেয়ে নির্মম হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে তুরস্কে। তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভিতরে টুকরো টুকরো করে কেটে সৌদি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্বে তোলপাড় হলেও এ হত্যাকান্ডের পেছনে যে সৌদি রাজপরিবার জড়িত তা প্রকাশ্যে উঠে আসে।
বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নানা ধরনের ঝুঁকি প্রায় সময় সাংবাদিকদের তাড়িয়ে বেড়ায়। গত কয়েক বছরে বিশ্বে অসংখ্য সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। শত শত সাংবাদিক গ্রেফতার হন। বিশেষ করে সৌদি, তুরস্ক, মিয়ানমার, চীনসহ কিছু দেশের রাষ্ট্রনায়করা সমালোচনা সহ্য করার কোনো শক্তিই রাখেন না। সুযোগও দেন না।
ইরাক যুদ্ধে দেখা গেছে, ‘এমবেডেড জার্নালিজম’-এর নামে কী করে সাংবাদিকতা ক্ষমতাশালী মার্কিন রাষ্ট্র ও মিলিটারি করপোরেশনের ‘রক্ষিতা’য় রূপান্তরিত হয়েছিল। অবজারভার পত্রিকা ২০০৩ সালে হিসাব কষে দেখিয়েছিল ইরাক যুদ্ধের কাভারেজ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার মুনাফার পরিকল্পনা করেছে রয়টার্স। লন্ডনভিত্তিক নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা নিবন্ধে সাংবাদিক জন পিলজার পরিসংখ্যান হাজির করেছিলেন, ইরাক যুদ্ধের সময় বিবিসির যুদ্ধবিরোধী কাভারেজের হার ছিল ২ শতাংশ। গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্যানুসারে ১৯৯১ সালে বিবিসি তার সংবাদকর্মীদের বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর ছবি দেখানোর ব্যাপারে ‘সতর্ক’ থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল।
কিছুদিন পরই ১৯৯১ সালের ক্রিসমাসের আগে লন্ডনের মেডিকেল এডুকেশন ট্রাস্ট জানায়, ‘নিখুঁঁত আঘাত’ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ২ লাখের বেশি ইরাকি নারী-পুরুষ-শিশু মারা গেছে। এ চরম সত্যসংক্রান্ত একটি সংবাদও বিবিসি প্রচার করেনি। কমবেশি সেই এমবেডেড বাস্তবতার মধ্যেই আমাদের মূলধারার সাংবাদিকতা ঘুরপাক খাচ্ছে এখনো।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে উইকিলিকসের ভূমিকা ছিল অনন্য। ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন নথির মধ্যে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধ সম্পর্কিত ৭৬ হাজার এবং ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত আরও ৪০ হাজার নথি ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও পেন্টাগনকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নথি ফাঁসের পর এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বলেছিলেন, ইরাক যুদ্ধের আগে থেকেই যে সত্য আড়ালের প্রচেষ্টা চলছে, দলিল ফাঁস করে দিয়ে সে সত্যটিকেই মানুষের সামনে আনা হয়েছে।
উইকিলিকসে মার্কিন সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিং কর্তৃক ফাঁস করে দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে শত শত বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেছে। ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্যের মধ্যে ছিল একটি ভিডিও, যেখানে দেখা গেছে- ইরাকের বাগদাদে মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে চালানো হামলায় কীভাবে বেসামরিক নাগরিকদের মরতে হয়েছে। ভিডিওতে একটি কণ্ঠকে বলতে শোনা গেছে, ‘সবাইকে জ্বালিয়ে দাও’। উইকিলিকসের উন্মোচন ছাড়া এসব কি আমরা জানতে পারতাম, ‘নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা’র মধ্য দিয়ে? তাই বিশ্বের ক্ষমতাধরদের কাঁপিয়ে দিয়ে লন্ডনে বিচারাধীনই নন, সাংবাদিকতার নতুন দুয়ার খোলেন। করোনাকাল বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যমের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জের। এ যুদ্ধে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার যেমন বিকল্প পথ নেই, তেমনি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে পেশাদারি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান রক্ষায়।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।