বিএনপি নেতারা প্রায়ই বলতেন আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, তবে... কিন্তু... ইত্যাদি.... ইত্যাদি ...! গত কয়েকদিন ধরে তাজউদ্দিন আহমেদ নিয়ে আমারই ভাই বোনদের উক্তিটাও আমার কাছে তেমনই লাগছে। আমরাও তাজউদ্দিন আহমেদকে সন্মান করি, বঙ্গবন্ধুর ডান হাত তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছেন, তবে...কিন্তু...ইত্যাদি...ইত্যাদি...! বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের জন্মদিবস থেকে শুরু হওয়া তাজউদ্দিন বধ প্রজেক্ট কে বা কারা শুরু করে? তার মেয়ের লেখা বই নিয়ে যদি ব্যাবচ্ছেদ করতে হয় তবে কি বছরের বাকি ১১ মাসে তা করা যায় না? আপনারা কত বড় বিশাল দেশপ্রেমিক আর মুজিব সেনা হয়ে গেছেন যে আপনাদের কাছে তাজউদ্দিনের পরিবারকে প্রমাণ দিতে হবে যে তারা বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু মানেন, কত স্কয়ারফুট শ্রদ্ধা করেন?
যে বই নিয়ে তাজউদ্দিনের পরিবারকে হেয় করতে উঠে পড়ে লেগেছেন সেই বই ১৭ কোটি মানুষের দেশে হাজার খানেক বিক্রি হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আপনাদের লেজে কেরোসিন লাগিয়ে হাতে জ্বলন্ত কাঠি ধরিয়ে দিলো রাজাকারের নাতি আর গণভবনকে হাওয়া ভবন করতে যাওয়া এক ভাই। আপনারা নিজ দায়িত্বে সেই জ্বলন্ত কাঠি দিয়ে নিজের লেজে আগুন ধরিয়ে লংকাকাণ্ড করতে শুরু করলেন। একবারও ভাবলেন না যে পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তির নজির নেই, যার সন্তানদের এবং গোটা পরিবারকে বেইজ্জতির মাধ্যমে সেই লোকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব।
সোহেল তাজকে আজ ছাগল বলে যে অর্বাচীনটা ফেসবুকে লিখছে, সে কতবড় আওয়ামী লীগ? কোন যোগ্যতায় তারা এসব অপমান করতে সুযোগ ও সাহস পাচ্ছে? সংসদ ভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যার পাশে সৎ, বিশ্বস্ত এবং জীবন গেলেও বেঈমানি করবেন না তাজউদ্দিন সন্তানদের মতো এমন সাংসদ জরুরি? নাকি, পরিস্থিতি বেগতিক হলেই এবং নিজের ফায়দা পেলেই নেত্রীর সাথে পল্টি মারা লোক জরুরি? এসব কিন্তু ৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত কম হয়নি। তাজউদ্দিন বিরোধী নানা ষড়যন্ত্র করে শেষে খন্দকার মোশতাকেরা সফল হয়েছিলো। ফলাফল কি হলো সেদিন? বঙ্গবন্ধুকে চিরতরের জন্য হারালাম, হারালাম তার পুরো পরিবারকে।
খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলো আজকের এই কুচক্রি ভাইদের মতো অনেকে। অনেকে মুচলেকা দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকলো। কিন্তু সেই দিন তাজউদ্দিন আহমেদসহ জাতীয় চার নেতার কেউ বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানি করেননি। তারা চাইলে মোশতাকের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা এবং জীবন দুটোই সুরক্ষিত করতে পারতেন। খন্দকার মোশতাক এবং জিয়া খুব ভালো করেই জানতেন তাজউদ্দিনের মাথার দাম কত। একবার যদি তাকে ভেড়ানো যেতো তবে আজ আমরা ইতিহাসটা কেমন পেতাম? জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ শোধ করেও কেনো বার বার তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি কতটা যোগ্য এবং যৌক্তিক ছিলেন?
কতবার তার সন্তানেরা প্রমাণ দেবেন যে তারা বেঈমান না, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের জন্য তারা জীবন দিতে জানেন? আজ যারা তাজউদ্দিনের পরিবার নিয়ে নোংরামিতে মেতেছেন, বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে বই লিখেছে বলে অভিযোগ করছেন, তারা কি কেউ বইটার প্রকাশনা বাতিলের মামলা করেছেন? ২০১৪ সালে প্রকাশিত এই সব কটা বই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার পড়া, তারা কি কখনও মনে করেছেন যে এখানে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করা হয়েছে? তারা মনে করেননি কেন জানেন? কারন তারা বঙ্গবন্ধুর উচ্চতা জানেন, আপনার মতো বায়বীয় আবেগে তারা বঙ্গবন্ধুকে বিচার করেন না। বইয়ের লেখক কে তারা ছোটবেলা থেকেই আদর করেছেন নিজের আপন বোনের মতো করে। এই মেয়ের লেখায় বঙ্গবন্ধু কোথাও ছোট হবেন না তা তারা ভালো করেই জানেন। কারণ বঙ্গবন্ধু এই মেয়েরও আবেগের জায়গা, যার জন্য তার বাবা নিজের জীবন কোরবানি করে দিতে পারে তার প্রতি অভিমান জমতে পারে, অশ্রদ্ধা জমবার কোনো সুযোগ নেই।
আপনাদের অতি ইমোশনে আজ আবারও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষে যুদ্ধ করা অনলাইন আ্যক্টভিস্ট দুই ভাগে বিভক্ত। সুযোগে মাথা গলাতে শুরু করেছে প্রথম আলোর মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমানেরা। তাদের ভাড়া করা লোকজন দিয়ে সোহেল তাজের পোস্টে কমেন্ট দেওয়াচ্ছে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করাবার। উদ্দেশ্য একটাই, শেখ হাসিনাকে দূর্বল করা, তার পাশ থেকে সৎ ও বিশ্বস্তজনদের সরিয়ে ফেলা। আপনাদের মগজ কম ব্যবহার করে ইমোশনটা ফুল ভলিউমে ব্যবহার করবার কুফল কি এখনও টের পাচ্ছেন না?
বঙ্গবন্ধু কন্যার পাশে একজন সৈয়দ আশরাফের শুন্যতা আমরা যখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, সেখানে বিকল্প হিসেবে কি সোহেল তাজকে মনে মনে চাইনি? এর বাইরে একটা নাম কি কারো বলতে পারবেন যিনি সৈয়দ আশরাফের মতো বিশ্বস্ততা ও সততা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার পাশে থাকবেন? বিগত ১২ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবার কারণে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আজ ভয়াবহ দুর্বল অবস্থায় আছে তা কি জানেন? আশরাফ সাহেবের বিদায়ের পর আওয়ামী লীগে হাইব্রিড ও কাউয়া শব্দটার সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই, যা এখন আমাদের কাছে দৈনন্দিন জীবন যাপনের একটি অংশ বনে গেছে। এই সর্বনাশের মাত্রাটা আর বাড়াবেন না।
দেশে একদল যেমন ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে দেশে ইসলামের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, আনাচে কানাচে জঙ্গি পয়দা করছে, তেমনি শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হয়ে আরও কিছু অর্বাচীন পয়দা হয়ে দলটাকে খন্ড বিখন্ড করছে বুঝে ও না বুঝে। পরিশেষে সোহেল তাজ ও তাজউদ্দিন সাহেবের কন্যাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইলো, আপনারা বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে দেখা করুন। তাজউদ্দিন আহমেদ এবং জোহরা তাজউদ্দিন আজ জীবিত নেই, শেখ হাসিনাই আপনাদের বাবা, মা, বড় বোন সবকিছু। অভিমান করবার যত বড় যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণ থাকুক না কেন, একটা সত্য তো অস্বীকার করেননি কখনও যে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মতো আপন আপনাদের এই দুনিয়াতে আর কেউ নেই। অভিমানেরও একটা সীমা থাকে, সমাপ্তি থাকে, মায়ের মতন বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে আপনারা ভাই বোন মিলে চলে যান। কিছুক্ষণ আবেগে কাঁদলেও সকলের মন হাল্কা হবে। আড়ালে থেকে কুটচাল চালাবার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে অনেক রথি মহারথিদের। দেশের জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য এই মুহূর্তে এই দৃশ্যটা সবচেয়ে জরুরি।
লেখক: সমাজকর্মী