#বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আইনজীবীদের সংগঠিত করেছিলেন সাহারা খাতুন: কামরুল ইসলাম।
#নিজে না খেয়ে কর্মীদের খাওয়াতেন সাহারা খাতুন আপা: আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।
#ব্যক্তি সাহারা খাতুন আপার কোনো দুর্নাম কেউ কোনোদিন করতে পারবে না: নাজমা আক্তার।
#ছোটখাটো নেতারা অনেক টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন, মন্ত্রী হয়েও সাহারা আপা ছিলেন সততার উৎকৃষ্ট উদাহরণ: সৈয়দ মিজানুর রহমান।
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যে কয়জন নেতা মাঠে সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, নিয়মিত নির্যাতন সহ্য করেছেন তাদের মধ্যে সদ্য প্রয়াত এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন অন্যতম। তার মতো কর্মীবান্ধব নেত্রীর অভাব কখনোই পূরণ হবার নয় বলে দাবি করেন আলোচকরা। দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপে এসব কথা বলেন আলোচকরা।
সোমবার (১৩ জুলাই) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাড. কামরুল ইসলাম, ঢাকা ১৭ আসনের সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন।
এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সাথে আমার পরিচয় বা সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তার সাথে ১৯৭৫ সালের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার দীপ্ত পদচারণা ছিল। ১৯৮৭ সালে আমি যখন মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হই, তখন তিনি ওই কমিটিতে ছিলেন সহ-সভাপতি। পাশাপাশি তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। হরতালের সময় তিনি ফার্মগেট এলাকায় মিছিলের সামনে ছিলেন। অনেক সময় পুলিশী নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। বিশেষ করে ২০০১-২০০৭ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আমলে আওয়ামী লীগের বিশেষ করে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। তখন সাহারা আপা, আমিসহ আরো কয়েকজন দিনরাত আদালতে কাজ করেছি। আওয়ামী লীগে আইনজীবীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমার ৩৫ বছরের আইন ক্যারিয়ারে তার নেতৃত্বেই কাজ করেছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সাথে একসাথে কাজ করেছি। তিনি তৃণমূলপর্যায় থেকে উঠে এসে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ প্রেসিডিয়াম পদে আসীন হয়েছেন। খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া আসনে মাত্র ২ থেকে আড়াইহাজার ভোটে হেরেছিলেন। তবে ১৯৯৬ সালে তাকে মনোনয়ন না দিয়ে রহমত উল্লাহকে মনোনয়ন দেয়া হলে, তিনি তার জন্য নির্বাচনের মাঠে কাজ করছেন।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আইনজীবীদের সংগঠিত করেছিলেন সাহারা খাতুন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১৬৩ দিনের কার্যদিবসে একদিনের জন্যও অনুপস্থিত ছিলেন না তিনি। সাহারা খাতুন আপা ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সাহস দিয়েই রাজনৈতিক মাঠে কর্মীদের জন্য কাজ করে গেছেন।
আকবর হোসেন পাঠান ফারুক বলেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন আপা। আমি ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতি শুরু ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করি। ৭৫ এর পর মাত্র ৫-৭ জন বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাইতেন। তাদের মধ্যে সাহারা আপাও ছিলেন। আমি একদিন শুটিং থেকে খুব সকালে সাহারা আপার বাসায় গিয়ে চা আর ডাল পুরি খাওয়ার কথা কোনোদিন ভুলবো না। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং সাহারা খাতুন আপার মধ্যে নেতৃত্বে মিল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার সিরাজগঞ্জে গেলে সেখানকার লোক আজকের বঙ্গবন্ধু সেতু চেয়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া মনসুর আলী, তুমি তো বলবে সেতুর কথা। তেমনি সাহারা আপাও এক অনুষ্ঠানে আমাকে বললেন, লোকজন আমার কথা শুনতে চায়।’ তিনি নিজে না খেয়ে কর্মীদের খাওয়াতেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের মামলা লড়েছেন। তিনি বলতেন, তোরা তো আমাকে কিছু দিতে পারবি না। অনেক সময় আদালতে আসামিদের আগেই উপস্থিত হতেন সাহারা খাতুন আপা। আমরা একজন বড় মাপের নেত্রী হারিয়েছি। ভবিষ্যতে তার মতো নেত্রী পাওয়া আমাদের জন্য দুস্কর হবে।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের মাধ্যমে আমরা সকল আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত ছিলাম। তখন সাহারা আপা আমাদের পাশে দিলেন।
ভোরের পাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি ফারুক আরো বলেন, অভিমান থেকেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু বুজতেন এবং জানতেন বলেই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভেতরে যে জ্বালা রয়েছে, তা আমরা কতজন দেখতে পেরেছি। আমি মনে করি, নেত্রীর চারপাশে অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো আমাদের বলতে হবে। রাজপথে আমাদের আবার নামতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিুযুদ্ধের কথা বলতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ছিলেন আমাদের প্রদীপ। ৬ মার্চ রাতে রেসকোর্স ময়দানে ঘুমিয়েছিলাম। ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে অনেক আদর পেয়েছি। আমাদের অভিমান ভেঙে কাজে নামতে হবে।
নাজমা আক্তার বলেন, আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদেনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভোরের পাতা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে আমরা যুব মহিলা লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমরা জানি, সাহারা আপা একজন কর্মীবান্ধব নেত্রী ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেছেন। তিনি সততা, ত্যাগ দিয়েই শেখ হাসিনার বিশ্বাস অর্জন করতেন। আমরা অনেক নারী নেত্রীই পুরুষ নেতাদের কাছে সব কিছু বলতে পারতাম না। সবাই আগে সাহারা আপার কাছে যেতাম। নেত্রীকে কিছু বলতে না পারলে, আমরা সাহারা আপাকে বলতাম। আমাদের সকল অভিযোগ অনুযোগ বলতে পারতাম সাহারা আপার কাছে। বিএনপি-জোট সরকারের আমলে হরতালের সময় আমাদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হতো। তখন থানায় একদল আইনজীবী নিয়ে হাজির হয়ে খবর নিতেন। রাতে খাবার দিতেন। এরপর দিন আদালতে আমাদের পক্ষে দাঁড়াতেন জামিন করার জন্য। অনেক সময় জেলে যেতে হয়েছে, তখন তিনি জেলে গিয়ে আমাদের সাহস দিতেন। তিনি অনেক মানবিক নেত্রী। আইনজীবী হিসাবে অনেকে মনে করতেন, আমাদের পাশে দাঁড়ালে লোকসান হবে। কিন্তু তিনি আমাদের পাশে সব সময়ই ছিলেন। আমরা অন্য কারো কাছ থেকে এমনটা আর পাবো না।
তিনি আরো বলেন, ওয়ান ইলেভেনে যখন নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেদিন রাতে অনেকে ফোন করেছিলাম। অনেকেই ফোন ধরেননি। কিন্তু সাহারা আপা ঠিকই ফোন ধরেছিলেন। যুব মহিলা লীগের নেত্রী হিসাবে তখন আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ৬ মাস পলাতক থাকতে হয়েছিল। ওই সময় সাহারা আপা সবসময়ই খোঁজ নিয়েছেন। পুরুষ নেতারা অনেক সময় নারী নেত্রীদের অবজ্ঞা করেন, নারী নেত্রীরা যদি সাহারা আপার মতো মানবিক হন, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো। আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, ব্যক্তি সাহারা খাতুন আপার কোনো দুর্নাম কেউ কোনোদিন করতে পারবে না। তার উত্তরা এলাকার বাসিন্দা হিসাবে আমরা একটা দুঃখ পেয়েছি, এই করোনার কারণে বড় করে জানাযা করতে পারেনি।
সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, সাহারা আপাকে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি। ৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফার্মগেট। হরতাল মানেই আওয়ামী লীগের মিছিলে কালোমতন একজন মহিলা। তিনি তখন এত বড় নেত্রী আমরা বুঝতাম না। ২০০১ সালে সময় হরতালের সমর্থনে আমরা পুরো ফার্মগেট এলাকায় মিছিল বের করলাম। সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাহারা খাতুন আপা। তখন পুলিশ আমাদের এলাকার তিনটা ছোটভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর আমি খুব চিন্তায় পরেছিলাম, অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া একটা ছেলের বাবাকে আমি কি জবাব দিবো। এরপর সাহারা খাতুন আপা পরের দিন তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি একটা টাকাও নেননি। উল্টো আমাদের ওই সময়ে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। এরপর ২০০৪ সালেও আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের পর জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা যখনই সময় পেতাম, তখন সাহারা আপার বাসায় নিয়মিত চা খেতে যেতাম। তখন আমরা সাহারা আপার বাসায় যে আসবাবগুলো দেখেছি, দুইটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার পরও সেখানে কোনো পরিবর্তন দেখিনাই। আমরা তাকে দেখেছি, মমতাময়ী মায়ের ভূমিকায় কিভাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন।
সাহারা খাতুনের সততা নিয়ে সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন কিনা জানি না; ৪ বছর আগে সিঙ্গাপুরের একটি হাসাপাতালে বিল দিতে পারেননি বলে, আরো দুইদিন বেশি থাকতে হয়েছিল। আজকের সমাজে অনেক ছোটখাটো নেতারা অনেক টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন, সেদিকে সাহারা আপা ছিলেন সততার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি হয়তো বই লিখে যেতে পারেননি, তবে তার সাথে ঘনিষ্ঠ যারা আছেন, তারা বই লিখলে নতুন প্রজন্ম সাহারা খাতুনকে জানতে পারবে।