অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ও অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই অদ্ভুত সময়টায় আমাদের দিনগুলো কেমন যেন উলটেপালটে গেছে। বদলে গেছে দিন আর রাত, প্রতিদিনের অভ্যাসগুলো, এমনকি আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ধরনগুলোও। আমরা এখন অফিস করি বাসায় বসে, বাজার করি সেটাও অনলাইনে। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করায় এই যে ইতিহাসের দীর্ঘতম সরকারি ছুটি, শুধু বাংলাদেশেই না বরং গোটা পৃথিবীতেই, তাতে ব্যক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রের ক্ষতির মাত্রাটাও কিন্তু অপূরণীয়। শুধু আমাদের সরকারই প্রথম পর্যায়ে কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ করেছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর এই ক্ষতির পারদটা যাতে আরো ঊর্ধ্বমুখী না হয়, আমরা যাতে আরো তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারি স্বাভাবিক দিন আর রাতে, সেজন্যই আমাদের এই দীর্ঘ ছুটি বা লকডাউন।
লকডাউনের এই সময়টায় বিশেষ করে হাসপাতালগুলোয় স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই সংকুচিত করে আনা হয়েছে। এর কারণ কিন্তু এই নয় যে আমাদের সহকর্মীরা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের জায়গাগুলো থেকে সরে এসেছেন। বরং প্রতিদিন আমাদের এমনি অনেক সহকর্মী কর্মক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দফায় দফায় প্রমাণ করছেন যে ‘কাদম্বিনী মরে নাই’। হাসপাতালের সেবা সংকুচিত করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে যাতে এই সময়টায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় এবং প্রয়োজনে কোভিড রোগীদের সেবায় তাদের আরো বেশি সংখ্যায় কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি তারা যদি সংক্রমিত হন, তাহলে তারা যে শুধু তাদের পরিবার-পরিজনকেই সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলবেন তা নয়, বরং তারা হয়ে উঠতে পারেন ‘সুপার স্প্রেডার’, অর্থাত্ তাদের থেকে এই রোগ খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অন্যান্য রোগীসহ হাজারো মানুষের মধ্যে।
কিন্তু তাই বলে রোগ-শোক তো থেমে থাকে না। লকডাউন, সংকুচিত চিকিত্সাসেবা আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অবর্তমানে সাধারণ রোগীদের সুযোগ নেই আগের মতো হাসপাতালে গিয়ে চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়ার। করোনাকালে আমাদের জীবনে আরো অনেক নতুনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজনটি হচ্ছে টেলিমেডিসিন। এজন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া আর বেশ কিছু নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন। ঘরে বসেই নাগরিক সুযোগ পাচ্ছেন টেলিফোনে চিকিত্সাসেবা নেওয়ার।
এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চিকিত্সা সহায়তা কমিটি। চলমান ছুটি শুরুর পরপরই কমিটির উদ্যোগে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সারা দেশে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে দেশবরেণ্য বিশিষ্ট চিকিত্সকদের স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান, অধ্যাপক ডা. আমজাদ হোসেন, অ্যধাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক, অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, অধ্যাপক ডা. বরেন চক্রবর্তী, অধ্যাপক ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জি, অধ্যাপক ডা. শাহিন আখতার, অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমরা বড়ুয়া, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান (বাবু), ডা. নুজহাত চৌধুরী, ডা. সুচরিতা দেওয়ান প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে হ্যান্ডবিল আকারে মুদ্রণ করে এটির ছয় লক্ষাধিক কপি নির্মূল কমিটির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে সারা দেশে বিতরণ করা হয়।
প্রেস রিলিজের মাধ্যমে এই কমিটি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিত্সকদের সমন্বয়ে ১০৮ সদস্যের একটি প্যানেল ঘোষণা করে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ফেসবুক পেজ-এ স্বাধীনতার পক্ষের এসব চিকিত্সকের বিস্তারিত তথ্য পোস্ট করা হয়েছে। দেওয়া আছে তাদের মোবাইল নম্বর, বিশেষায়ণের ক্ষেত্র ও টেলি-কনসালটেশনের সময়সূচি। এসব নম্বরে ফোন করে যে কোনো ব্যক্তি চিকিত্সাসংক্রান্ত পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।
তবে করোনাকালের এই দিনগুলোতে সবচেয়ে যা জরুরি, তা হলো মাথা ঠান্ডা রেখে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটি নেওয়া। আমরা এখন সবাই কম-বেশি জানি যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোভিডের মূল লক্ষণগুলো হলো জ্বর, শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্ট। এর সঙ্গে কারো কারো শরীর ব্যথা, ডায়রিয়া আর ঘ্রাণ নেওয়ায় সমস্যা থাকতেও পারে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন কোভিড রোগীর তো রোগের কোনো লক্ষণই থাকে না। তাই বলে কোভিডের মতো লক্ষণ দেখা দিলেই যে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে বা কোভিডের পরীক্ষা করতে হবে ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। জ্বর, কাশির মতো কোভিড-লাইক লক্ষণ দেখা দিলে ধৈর্য ধরে প্রাথমিক পর্যায়ে বাসাতেই চিকিত্সা নেওয়া যায়। জ্বরের জন্য ছয় থেকে আট ঘণ্টা পরপর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আর কাশির জন্য যে কোনো একটি এন্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট প্রতি রাতে খাওয়া যেতে পারে। যদি জ্বর তিন থেকে চার দিনের মধ্যে না কমে বরং বাড়তে থাকে কিংবা শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে কোভিডের পরীক্ষা করা ও চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এ সময়টায় ভালো থাকার জন্য কিছু কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। বেশি করে পানি খেতে পারেন এবং তা কুসুম গরম হলেই ভালো। খাওয়ার অভ্যাসেও একটু সচেতন হওয়া উচিত। বিশেষ করে রাতের বেলা ভাতটা বাদ দিতে পারলে মন্দ হয় না। ভিটামিন সি এবং অন্যান্য ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ভালো। হালকা ব্যায়াম করা উচিত প্রতিদিনই। ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজই এজন্য যথেষ্ট। আর পাশাপাশি দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় কোভিড-সংক্রান্ত খবরাখবর সংগ্রহের পেছনে ব্যয় করা উচিত না। খবর না পাওয়াটা খারাপ, কারণ এতে একধরনের অজানা শঙ্কা মনে জেঁকে বসতে পারে। একইভাবে যদি দিনের বেশির ভাগ সময় এ কাজে ব্যয় করা হয়, তাহলে ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি নানা ধরনের গুজব আর মিথ্যা সংবাদ বড়ো ধরনের বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। বই পড়া একটি ভালো অভ্যাস। যে বইগুলো অনেক দিন ধরে পড়ি-পড়ি করে পড়া হয়ে ওঠেনি সময়ের অভাবে, সেগুলো এই সময়ে পড়ে নেওয়া যেতে পারে। শোনা যেতে পারে গানও।
সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই আমরা দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সুদিনের প্রত্যাশায় আছি। আঁধার কেটে সূর্য হাসবেই। অপেক্ষা শুধু সময়ের। একাত্তরে সূর্যের প্রতীক্ষায় আমরা পার করেছিলাম একটি নববর্ষ, একটি রমজান, একটি শারদীয় দুর্গোত্সব, দুটি ঈদ আর নয়টি দীর্ঘ মাস। তারপর একসময় সূর্য হেসেছিল। হাসবে এবারও, সময়ও লাগবে তারচেয়ে অনেক কম। কাজেই ধৈর্য একটু ধরতেই হবে। আর এই কঠিন সময়টায় সাধারণ রোগীদের চিকিত্সা পাওয়া আর ভালো থাকাটা আরেকটু সহজ করতেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমাদের এই চেষ্টাটুকু।
লেখকদ্বয়: যথাক্রমে পরিচালক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সভাপতি, চিকিত্সা সহায়তা কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূূল কমিটি এবং চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, চিকিত্সা সহায়তা কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি