ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার
দেখতে দেখতে ৮ দিন হলো আম্মা আমাদেরকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আপনাদের সবার দোয়ায় আল্লাহ অবশ্যই ওনাকে ভালো রেখেছেন, উনি শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের তো ঘুম আসে না। ঘুমাতে গেলেই দেখতে পাই আম্মার অচেতন দেহ, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ICU-ভেন্টিলেটর, যান্ত্রিক নিঃশাস, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ....আরো কত কি। ঘুমাতে গেলেই শুনতে পাই ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে আসা ফোন কল, আম্মাকে ডিসচার্জ করে দেওয়ার নির্দেশ, দায়িত্ব না নিয়েই সকল রীতিনীতি, মেডিকেল এথিক্স, রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আম্মার কাছ থেকে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া, হাসপাতাল কতৃপক্ষের সামনে আমার দুই ভাইয়ের অসহায়ত্ব, সকল সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই আম্মাকে বাঁচানোর নিষ্ফল প্রয়াস, আরো কত কি।
COVID 19 এর ভয়াবহতা থেকে বিশ্বের গরিব দেশগুলোকে রক্ষার জন্য বিশ্ব ব্যাংক ১৪ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ওই কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন দেশে অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কাম্বোডিয়া আর লাওস পেয়েছে ৫২ মিলিয়ন আর বাংলাদেশ পেয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো এইবার মাত্র ২ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে আমরা প্রজেক্ট তৈরী আর বোর্ডের অনুমোদনের কাজ শেষ করেছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত আমার অন্য সহকর্মীরা বাংলাদেশের প্রজেক্ট তৈরী করেছেন। আমার দায়িত্বে ছিল কাম্বোডিয়া আর লাওসের প্রজেক্ট তৈরির কাজ। চারিদিকে COVID এর আতংকের মধ্যেও অনেক সময় রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত অফিসে থেকেছি। এইতো মার্চের শেষ সপ্তাহের কথা | আম্মা তখন কিছুটা অসুস্থ। অনেক কাজের চাপে নিজেকে চাঙ্গা রাখার জন্য আম্মা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা। ক্লান্ত হলেই আম্মার সাথে মিনিট দুই কথা বলতাম-সকল ক্লান্তি কেটে যেত। উনি খুব খুশি হতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন যখন শুনতেন সাধারণ মানুষকে COVID এর মরণথাবা থেকে রক্ষা করার জন্য কিছুটা হলেও কাজ করতে পারছি। আমার বন্ধু-সহকর্মী সহ অনেকেই আমাদের মা ছেলের এই ঘনিষ্ঠতার কথা জানতেন।
আম্মাকে বলতাম এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাক-ফোকরের কথা-টেস্ট কিট নেই, PPE নেই, আধুনিক পরীক্ষাগার নেই, ডাক্তার সহ স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষন নেই, জনগণের সচেতনার জন্য ভালো ক্যাম্পইনের ব্যবস্থা নেই, হসপিটালে আইসোলেশন সেন্টার নেই, গুরুতর রোগীদের নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা নেই, ভেন্টিলেটর নেই, কোয়ারেন্টীনের ভালো ব্যবস্থা নেই, আরো কত কি। কথার ফাঁকে ফাঁকে COVID প্রজেক্টের ডিজাইন আম্মার সাথে শেয়ার করতাম, পরামর্শ নিতাম, মতের আদান প্রদান করতাম। তাতে করে কাজের এক ঘেয়েমি দূর হওয়ার সাথে সাথে নতুন আইডিয়া এবং এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনাও পেতাম। মাঝে মাঝে আম্মার বিচক্ষণ পরামর্শ শুনে তার জ্ঞানের পরিধি দেখে অবাক হতাম।
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস। সেই করোনা সৃষ্ট জটিলতাতেই আম্মাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। উনি কি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিলেন, যার ছেলে অন্য দেশের জন্য শত শত ভেন্টিলেটর কেনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে তাকেই ভেন্টিলেটর থেকে অন্যায় ভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে? তার ডাক্তার ছেলেদের চরম অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে হবে? অক্সিজেনের অভাবে তাকে চির নিদ্রায় চলে যেতে হবে? অনেকেই নিয়তির হাতে হয়তো এসব কিছুকে সমর্পন করতেন, কিন্তু আমি মেডিকেল সাইন্সের দৃস্টিতে দেখতে পাই-ইউনাইটেড হসপিটালের মানুষরূপী ঐসব অধমদের যারা আম্মাকে কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সমমানের অক্সিজেনের ব্যবস্থা না করে ভেন্টিলেটর থেকে ছাড়িয়ে ডিসচার্জ করেছিল। রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলো। ভাবলে অবাক লাগে বাংলাদেশে আইন আজ কোন পর্যায়ে অসহায়ত্বর মধ্য দিয়ে যাচ্যাচ্ছে!!
শুনেছি ইউনাইটেড হসপিটালের প্রধান কমুনিকেশন অফিসার পড়াশুনায় একজন ডাক্তার। উনি সাংবাদিকদের বলেছেন-আমার ভাইদের সাথে আলোচনা করেই আম্মাকে ভেন্টিলেটর থেকে খুলে ফেলা হয়েছিল। কথাটা শুনে অনেক কষ্টের মধ্যেও তার জন্য খারাপ লেগেছে। আমাদের দেশের মেডিকেল কারিকুলামে মেডিকেল এথিক্স সম্পর্কে যতটুকু পড়াশুনা করানো হয় ততটুকু জানলেও একজন ডাক্তার কখনোই এমনভাবে মনগড়া কথা বলতে পারতেন না। চাকরি করতে হয় বিধায় হয়তো ওনাকে নিজ জ্ঞানের বহির্ভুত কথা না চাইলেও বলতে হয়, কিন্তু তাই বলে বিবেক, মানবিকতা ও পেশাগত শপথের কথা ভুলে গেলে কি চলবে? মানুষের রক্তচোসা মালিকপক্ষকে বাঁচানো কি খুবই প্রয়োজন? পশু একই গোত্রের আরেকটি পশুর মাংস খায় না কিন্তু মানুষ হয়তো খায়। ডাক্তার হয়ে আরেক ডাক্তারের মায়ের মৃত্যুর দায় এড়াতে-মালিককে বাঁচাতে এমন নির্লজ্জ চেষ্টা করবে তাতে সৃস্টিকর্তা সমান কষ্ট শাস্তি হিসেবে দিলে বিস্মিত হওয়া আর সমবেদনা জানানো ছাড়া কি করার থাকবে। সকলেরই মনে রাখা উচিত, আমাদের সকলের মা-সন্তান রয়েছে এবং তারাও ইউনাইটেড হাসপাতালের মত খারাপ অভিজ্ঞতা পেতে পারেন এবং তাদের হারাতে পারেন।
সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রশাসন, ডাক্তার ও সমাজকর্মী সহ আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি আমার এবং আমার ভাই বোনদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও প্রানঢালা ভালোবাসা। আমাদের পরিবারের চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে সবাই এগিয়ে এসেছেন, আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন, ইউনাইটেড হাসপাতালের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন| আম্মা মহান আল্লাহতালার হেফাজতে থেকে নিশ্চিত আপনাদের জন্য দোয়া করছেন। আমাদের এই প্রতিবাদ ওনাকে স্পর্শ করবে কারণ আমরা আমাদের সবার মাকে আগামীদিনে বাঁচাতে চাই।
আমার বিশ্বাস আমাদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও প্রয়াস ইউনাইটেড সহ বাংলাদেশের সকল বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা হলেও জনকল্ল্যাণমুখী করবে, দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করবে, হাসপাতালে রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করবে, স্বাস্থ্যনীতি মেনে চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য করবে এবং রোগীদের ও তাদের স্বজনদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করবে। আমরা জানি প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, কিন্তু বিশ্বাস করি ন্যায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ গণমানুষের কাছে টাকার লোভী অপশক্তিরা কখনো টিকে থাকতে পারবে না। আসুন আমরা সংকল্পবদ্ধ হই, আমাদের মা-বাবা-সন্তানসহ সকলের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করি। আমাদের অবশ্যই বেচে থাকার অধিকার আছে ।
(বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কম্বোডিয়ায় দায়িত্বরত ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)