একদম নিছক গল্প। এবার আরেকটা শুনুন। রাজধানী ঢাকায় বৈশাখের বিকালে এক লোক বের হলেন জরুরি কাজে। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। লোকটি গিয়ে আশ্রয় নিল একটি গাছের নিচে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ঝড়ে গাছটির বড় ডাল ভেঙে পড়ল লোকটির ওপর। এর মধ্যে ঝড় থামল। একজন মানুষকে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দেখে পথচারীরা খবর দিল ফায়ার সার্ভিসে। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলো। তারা দেখল ঝড়ে গাছের সঙ্গে ইলেকট্রিসিটির লাইটের খাম্বাও পড়ে গেছে। আগে খাম্বা সরাতে হবে। তারপর গাছের ডাল। বিপদে পড়ল ফায়ার সার্ভিস। সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগকে না জানিয়ে তারা কীভাবে কাজটা শুরু করবে। একটা প্রটোকলেরও ব্যাপার আছে। ডিপার্টমেন্টাল ঝামেলা তো আছেই। গাছের মালিক সিটি করপোরেশন। আর খাম্বার মালিক ডেসা। তাদের আগে জানাতে হবে। তারপর উদ্ধার অভিযান। ফায়ার সার্ভিস প্রটোকল মেনে জানাল সিটি করপোরেশনকে। এলেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তারা বললেন, কারও একলা সিদ্ধান্তে হবে না। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনকেও আসতে হবে। তারাও এলেন। এবার সবাই বললেন, ওয়াসাকে ডাকলে ভালো হয়। গাছের নিচে থাকা মানুষটি কাতর কণ্ঠে বললেন, ভাই! যারে খুশি ডাকা দরকার পরে ডাকুন। তার আগে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। আমাকে বাঁচান ভাইয়েরা। দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এগিয়ে গেলেন। মিডিয়া সবকিছু লাইভ করছে। কর্মকর্তারা বললেন, তোমার উদ্ধারের জন্যই আমরা এতগুলো মানুষ কষ্ট করছি। চেষ্টা করছি। ওপরে একটু পরপর রিপোর্ট করছি। আমাদের কষ্টটা তোমাকে বুঝতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা চলছে। অসহায় মানুষটির শ্বাস-প্রশ্বাস তখন আসে যায়। এ সময় মেডিকেলের অ্যাম্বুলেন্সও এসে হাজির। এগিয়ে যায় তারাও। বাকি ডিপার্টমেন্টগুলো বলল, ভালো হয়েছে তোমরা এসেছো। জরুরি উদ্ধার কমিটি হয়েছে। ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। দেখতে হবে কার কী দায়িত্ব। প্রটোকল অনুযায়ী কে কীভাবে কাজ করবে। এখানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিষয়ও আছে। বিশেষ করে মানবাধিকার সংস্থার। তাদের প্রতিক্রিয়াও দেখার বিষয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। ফ্লাডলাইট লাগানো হয় উদ্ধার অভিযানের সুবিধার্থে। মিডিয়া লাইভ চলছে সন্ধ্যা থেকে। রাতের টকশোগুলোতেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু গাছের লোকটার দম তখন যায় যায়। সিদ্ধান্ত ঝুলতে থাকে। সমন্বয় আলোচনা হতে থাকে উদ্ধারের জন্য আনা জিনিসপত্রের মান নিয়ে।
আচ্ছা কেউ আমাকে বলবেন, আমাদের এমপি সাহেবদের ধান কাটতে হবে কেন? সাহায্য করতে হলে কৃষককে নগদ টাকা দিন। তারা ম্যানেজ করবে সবকিছু। ছাত্রলীগ অবশ্যই ভালো কাজ করেছে। তাদের প্রশংসা প্রধানমন্ত্রী করেছেন। আমরা মিডিয়াও করছি। এই দেখে বড় সাহেবদের ঘুম হারাম হয়ে গেল। তারা শুরু করলেন ফটোসেশন। বুঝলাম না কিছুই। কেন নাটক করতে হবে এই দুঃসময়ে? আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানোর কাজের কি অভাব পড়েছে? মানুষ স্বাভাবিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। ঘাটে ঘাটে সমন্বয়হীনতা। অসহায় মানুষের আর্তনাদ ঘরে-বাইরে। জীবন-জীবিকার এক কঠিনতম সংগ্রাম চলছে। এই সময়ে কৃষক নিয়ে হাসি-ঠাট্টার কী দরকার জনপ্রতিনিধিদের? এখন ফটোসেশন করতে হবে লোক দেখানো? ধান কাটতে মাশরাফির কাছে শিখুন। ক্রিকেটে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজনীতি সেভাবে করেননি। আর করেননি বলেই নষ্ট হননি। ধান কাটার মেশিন দিয়ে দিয়েছেন কৃষককে। কৃষক মনের আনন্দে ধান কাটছে। এ যুগে কাস্তের দরকার নেই। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মেশিন আছে। এমপি সাহেবরা সেই কাজটুকু করলেই পারেন। আরেকটু বেশি করতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ যান। দেখুন কাউন্সিলর খোরশেদ কীভাবে কাজ করছেন। খোরশেদ আজ করোনা মোকাবিলার হিরো। ৩৫টি লাশের সৎকার করেছেন। সর্বশেষ দাহ করলেন ব্যবসায়ী খোকন সাহার লাশ। হঠাৎ অসুস্থ হলেন খোকন সাহা। প্রথমে ভাবলেন তেমন কিছু হয়নি। সামান্য গলা ব্যথা, জ্বর; ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। বন্ধ হয়ে আসতে থাকে শ্বাসপ্রণালি। জ্বরও বাড়তে থাকে। বাসায় ছোট দুটি মেয়ে আর স্ত্রী। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে ফোন করলেন একটু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেউ এগিয়ে এলেন না। শেষ মুহূর্তে স্ত্রী, মেয়েরা ধরাধরি করে চার তলা থেকে নামাতে থাকেন নিচে। কোনো একটি হাসপাতালে নিয়ে বাবাকে বাঁচাতে চায় মেয়েরা। কিন্তু শেষ সিঁড়ি অতিক্রম করা হলো না। মাঝপথেই ঢলে পড়লেন খোকন সাহা। চলে গেলেন চিরতরে। মেয়েরা চিৎকার করে বাবা বাবা বলে কাঁদতে থাকে। স্ত্রী ফোন করেন নিকটজনদের। কেউ এলো না। লাশের পাশে বসে থাকলেন তারা তিনজন। ওদের আর্তচিৎকার আর কান্নায় কারও মন গলল না। বন্ধ হয়ে গেল আশপাশের জানালাগুলো। খবর পেয়ে ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর খোরশেদ। সঙ্গে আসেন তার সহযোদ্ধারা। লাশটি তুলে নেন তারা। তারপর নিয়ে যান শ্মশানে। কিন্তু মুখাগ্নি করবে কে? পরিবারের কেউ নেই। খোরশেদ যোগাযোগ করলেন খোকন সাহার পরিবারের সঙ্গে। তারা অনুমতি দিলে খোরশেদ নিজেই মুখাগ্নি করলেন খোকন সাহার। ছাত্রলীগের একটি মেয়ে হিন্দুধর্মের। সন্ধ্যায় ইফতার বানিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন গরিব মুসলিম ভাইদের। এরই নাম মানবতা। মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানো।
একটা কঠিন সময় পার করছি আমরা। করোনাকালে ঠিক নেই কোনো কিছু। সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকনের মৃত্যু মিডিয়া কর্মীদের মাঝে ক্ষরণ তৈরি করেছে। ভাবতেও পারিনি খোকন এভাবে চলে যাবে। ভীষণ স্নেহ করতাম তাকে। কারণে অকারণে আমার কাছে আসত। অনেক সময় প্রশ্ন করতাম খোকন কেন এসেছ? বলত, ভাই কোনো কাজ নেই। আপনাকে দেখতে এলাম। মানুষের ভালোবাসা বড় অদ্ভুত। এই জীবনে অনেক মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে পছন্দ করে। খোকন তাদের একজন। সন্ধ্যায় শাবান মাহমুদ ফোনে বলল, খোকন গুরুতর অসুস্থ। সন্দেহ করোনাভাইরাস। গলা ব্যথা, জ্বর। ফোন করেছে বিকালে। রিজেন্ট হাসপাতাল ওর বাসার কাছে। ওখানে ভর্তি করেছি। আপনাকে জানাতে বলেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরপর বারবার শাবানকে ফোন করি। শাবানও আপডেটগুলো জানায়। সাড়ে ৭টার দিকে শাবান জানাল, অবস্থা ভালো না। ভেনটিলেটর দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের এমডি শাহেদ জানিয়েছেন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। মানসিকভাবে তৈরি থাকতে বলেছেন। শাবানকে বললাম, ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছ? শাবান বলল, কথা হচ্ছে। কিন্তু এখনো নেতিবাচক অবস্থা বলছি না। ওর স্ত্রী ও ছেলে হাসপাতালেই আছে। ওদের কিছু বলছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাড়ে ৮টায় শাবান বলল, মনে হয় ও আর ফিরে আসবে না। সাড়ে ৯টায় শুনলাম, সব শেষ। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার বাকি। রাত ১০টায় সেই ঘোষণাই দেওয়া হলো। খোকন চলে গেল আমাদের ছেড়ে। সময়ের আলো পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করত। ভালোমন্দে আমার পরামর্শ নিত। কুমিল্লার ছেলে হিসেবে আবদার ছিল আলাদা। কাজ করেছে আমাদের সময়ে, আমাদের অর্থনীতিতেও। খোকনের ছেলে ও স্ত্রী করোনা আক্রান্ত। মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। আল্লাহ এই পরিবারটিকে শোক সইবার তৌফিক দাও। গতকাল শুনলাম, সাতক্ষীরার মাঠপর্যায়ের একজন সাংবাদিকও চলে গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। শুধু সাংবাদিক নন, জীবন দিচ্ছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, ব্যাংকারসহ সম্মুখযোদ্ধারা। সিটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা চলে গেলেন। বয়স বেশি হয়নি। হেঁটে হেঁটে ঢুকলেন রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে। শরীরটা ভালো ছিল না। টেস্ট করিয়েছেন দুবার। রিপোর্ট এলো, না করোনা নয়। স্বস্তি নিয়েই বাসায় ফেরেন। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শরীর খারাপ হতে থাকে। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। দিনে কথা বললেন ফোনে সহকর্মীদের সঙ্গে। সবাইকে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। রাতে স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা বললেন। মন খারাপের কথা জানালেন। কাঁদলেনও। ফোনের এ পাশ থেকে পরিবারের সদস্যরাও কাঁদলেন। তারপর ঘুমাতে গেলেন। রাত ১টায় শরীর খারাপ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। চিকিৎসকরা ভেনটিলেটর দিলেন। ভোর ৫টায় সব শেষ হয়ে গেল। চলে গেলেন ব্যাংকার শাহরিয়ার। দুনিয়াকে বিদায় জানালেন। জানিয়ে গেলেন, ক্ষণিকের এই দুনিয়া। সবাই আজ আছি কাল নেই। সবাইকে চলে যেতে হবে একদিন। কিন্তু এভাবে যাওয়াটা বড় কষ্টের। করোনা যুদ্ধ আজ গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষ বড় অসহায়। এ অসহায় দুনিয়াতেও ক্ষমতার দম্ভ শেষ হচ্ছে না। হিংসা-বিদ্বেষ বন্ধ হচ্ছে না। বরং বাড়ছে। এখনো অনেকের বড়াই দেখি। ক্ষমতার দম্ভ দেখি। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো দেখি। মানবতার বিপক্ষে অবস্থান দেখি। বিবেকহীনদের কা-কীর্তি দেখি। জানি না, বৈশ্বিক মহামারী আমাদের কিছু শেখাতে পারবে কিনা।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।