বহু যুগ আগেই গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলে গেছেন যে ‘মানুষ হলো একটি রাজনৈতিক জীব’। ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজন ঘটার মধ্যদিয়ে শোষিত শ্রেণির ওপর শোষক শ্রেণির কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বস্তুত তখন থেকেই ‘রাজনীতির’ সূত্রপাত। এরপর থেকে সমাজে রাজনীতির চর্চা চলেছে, বিভিন্ন চিন্তাধারা ও মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে এবং ধারাবাহিকভাবে সে সবের অনুশীলনও অব্যাহত। শ্রেণি দ্বন্দ্বই রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিশেষভাবে প্রবল হয়েছে সামাজিক বিপ্লব অথবা গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থানের সময়গুলোতে। বিশ্বে প্রচলিত নানা মতবাদ রয়েছে যেমন; নৈরাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, বামপন্থী রাজনীতি, ডানপন্থী রাজনীতি, মার্কসবাদ, মৌলবাদ, সমাজতন্ত্র,সম্প্রসারণবাদ, সাম্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতাবাদ, ইসলামী সমাজতন্ত্র, উদারনীতিবাদ, ইত্যাদি মতবাদ।
তবে দেশে ৯০ দশকে নতুন একটি মতবাদ তৈরি হয়েছে যা এর আগে বিশ্বে কোনো দেশে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের নতুন মতবাদটি হল ‘ভাইতন্ত্রবাদ’। এই মতবাদটি মূল তৈরি হয়েছে ১৯৯০ সালে যখন ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়েছে এর পর থেকে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদগুলো ছিল নানা ইস্যুতে জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি, সেজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
তবে দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসু ও হল ছাত্র-সংসদগুলোর নির্বাচন বন্ধ থাকায় এই মতবাদটির জন্ম হয়েছে বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের ইতিহাস :
বাংলাদেশে ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ৯০ দশকে হয়েছে। এই মতবাদ অনুসারিদের ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে কিছুটা সফলতা আসলেও ২০০১ এবং ২০০৮ সালে এর ব্যাপক সফলতা লাভ করে। ২০০৮ সালের পর ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদ বিশ্বাসীদের আর পিঁছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাদের ক্রমবর্ধমান সফলতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈশ্বিক ভুমিকা রাখছে। শাখা-প্রশাখার বিস্তার লাভ করেছে দেশে বিদেশে। মূলত তারল্য নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদ অল্পদিনে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ এবং তাদের অনুসারির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদ নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভাইতন্ত্রবাদ সংগঠন থেকে বর্তমানে যে সুবিধা পচ্ছে তা ভবিষ্যতে পেতে হলে এই মতবাদ বিশ্বাসীদের নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করলে এর সুফল পাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন তাদের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে প্রচার-প্রচারনা করা। কারণ এই মতবাদটি তৈরির একমাত্র দাবিদার বাংলাদেশ।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদ কাকে বলে?
এই মতবাদের একজন ভাইকে ইমামের মতো অনুসরণ করতে হবে। ওই ভাই যে আদর্শ ধারণ করবেন সেই আদর্শ অনুসরণ করা। ভাই যখন যে দলের স্লোগান দিবেন সেই দলের স্লোগান দিতে কোনো দ্বিধাবোধ করা যাবে না। ভাইয়ের কথা মতো সবসময় কথা মিলাতে পারলেই এই মতবাদটি মানা সম্ভব। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভাইতন্ত্রবাদ রাজনৈতিক সংগঠনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এর সফলতা ব্যাপক। যে কোনো রাজনৈতিক দলকে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় রাখতে তাদের ভুমিকা অপরিসীম। কোনো কোনো বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংগঠনটি দলকে শক্তশালী করতে ৬০-৭০ শতাংশ ভুমিকা রাখতে পারে। যে রাজনৈতিক দল ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদীদের যত বেশি গুরুত্ব দেবে তাদের সফলতা তত বেশি আসবে।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের মূলনীতি কি?
ভাইতন্ত্রবাদ সংগঠনের মূলনীতি হচ্ছে তারল্যনীতি। অথাৎ এই নীতির বিশ্বাসীদের যখন যে পাত্রে রাখা হবে তখন সেই পাত্রের আকার, ধরণ, আকৃতি অনুযায়ী রূপ লাভ করবে। লেখক মোস্তফা মামুনের উপন্যাস ‘ক্যাম্পাস৯৫’ থেকে জানা যায় ভাইতন্ত্রবাদের তারল্য নীতির কথা। বইটিতে উল্লেখ্য আছে ১৯৯৫ সালের একটি রাতের ঘটনা। একদিন আগে যারা একটি দলের স্লোগানে মুখরিত ছিল সেই দল রাতে ক্ষমতা হারানোর পর একই ব্যক্তি আবার পরের দিন অন্যদলের স্লোগানে মুখরিত হয়েছে। এক রাতেই তাদের আদর্শ, নৈতিকতা এবং ভূল সবই বুঝতে পেরেছে। এখান থেকে ভাইতন্ত্রবাদের তারল্যনীতির কথা সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে তাদের নির্দিষ্ট কোনো দলের বা দেশের আদর্শ প্রয়োজন নেই। যখন যে ক্ষমতায় যাবে জোর গলায় তাদের স্লোগান দিয়ে মুখে ফেনা তুলতে হবে।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের আর্দশ কি?
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের আলাদা কোনো আদর্শের প্রয়োজন নেই। ভাইয়ের আদর্শ মানলেই এখানে চলবে। ভাইয়ের নৈতিকতা আছে কি না সেদিকে নজর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাইকে প্রটকল দেওয়া অন্যতম আদর্শ।
ভাইতন্ত্রবাদ রাজনৈতিক মতবাদে কি কি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন :
ভাইতন্ত্রবাদ রাজনীতিতে সফলতা পেতে হলে নিচের পয়েন্টগুলো অবশ্যই গুরুত্বদিতে হবে যেমন :
১. সকালে ভাই ঘুম থেকে উঠার আগেভাইয়ের বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকা।
২. সকালে সুপ্রভাত, রাতে শুভ রাত্রি এসএমএম এর মাধ্যমে স্বরণ করা।
৩. ভাইয়ের জন্মদিনে বড় কেক নিয়ে জায়গায় জায়গায় জন্মদিন পালন করা। এবং তা ফেসবুকে দিয়ে ভাইকে ট্যাগ করা।
৪. ভাইয়ের দূরআত্মীয় কেউ মারা গেলে আর তা শুনতে পেলে ফেসবুকে বুক ফেটে কান্না করা। অথাৎ ভাইয়ের সুখে হাঁইসবো আমি কাঁদিবো ভাইয়ের দুঃখে। নিজের খাবার বিলিয়ে দেবো ভাইকে সুখি দেখতে।
৫. ভাইয়ের জন্য বাজার করে দেওয়া, কাপড় পরিষ্কার করে দেওয়া।
৬. সংগঠনে পদ-পদবী পাওয়ার জন্য সকাল-বিকেল ভাইয়ের পা ধরে সালাম করা।
৭. সর্বোপরি লজ্জা পরিহার করা। ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদে বিশ্বাসী যারা তারা কোনো অবস্থায় লজ্জা রাখা যাবে না। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সফলতার সূত্র।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের সাফল্য
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদে বিশ্বাসীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। দেশে- বিদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিস্তার লাভ করেছে। ব্যাংকের মালিক হয়ে ব্যাংক থেকে ব্যাপক অর্থ হাতিয়ে নিতে পেরেছে। হেমল্যাটবাহিনী গঠনের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনকে তুলে দিতে পেরেছে। রাম-দা বাহিনী তৈরির মাধ্যমে মাঠ দখন রাখতে পেরেছে। এছাড়া ফুটপাতে চাঁদা আদায় করতে তাদের ব্যাপক সফলতা রয়েছে।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের ব্যর্থতা কি?
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের তেমন কোনো ব্যর্থতা নেই। তবে ভাই ক্ষমতায় না থাকলে নিজের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। এই ভাইয়ের অনুসারীরা যারা আছেন তাদের অনেক কষ্ট করতে হয় নতুন ভাইয়ের সন্ধানে। অনেকেই পড়া-লেখায় পিছিয়ে যান। অনেকের আবার কোনো চাকুরি বাকরি হয় না। সর্বোপরি কিছু হতাশা পাওয়ার সম্ভবনা থাকে। এই রিস্কগুলো নিতে পারলে ভাইতন্ত্রবাদের সফলতা আর সফলতা।
ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের ব্যর্থতা উত্তোলণের উপায়
১.ভাইতন্ত্রবাদ মতবাদের ব্যর্থতা উত্তোলনে সহজ উপায় হচ্ছে যে যে ভাইকে অনুসরণ করবে তাকে যেকোনো ভাবে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করতে হবে।
২.ভাইয়ের সকল কার্যক্রম ফোটো তুলে ফেসবুকে বেশি বেশি প্রচার করা।
৩.ভাই বেশি বেশি দান খয়রাত করার জন্য বেশি বেশি চাঁদা তুলে দেওয়া।
৪. ভাইয়ের ক্ষমতা বুঝাতে দিনে পাঁচ বার ভাইয়ের সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে ছবি দেওয়া
পরিশেষে বলা যায় ভাইতন্ত্রবাদ একটি আদর্শ যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয়, এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে দীর্ঘ স্থায়ী করতে এর ভুমিকা অপরিসীম। ভাইতন্ত্রবাদ রাজনীতিতে দলীয় ,দেশের বা গণতন্ত্রের আদর্শ মুখ্য বিষয় নয়। এখানে ভাইয়ের আদর্শই মুখ্য বিষয়। রাজনৈতিক বিষয় কোনো বই পড়ার চেয়ে ভাইয়ের সকল কার্যক্রম অনুসরণ করলে সফলতা নিশ্চিত।
লেখক : জামিল আহমেদ মোহন, সাংবাদিক