‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সাড়া জাগানো এই কবিতার কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ভোরের পাতার পাঠকদের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবি সেরা কয়েকটি কবিতা নিচে তুলে ধরলাম।
পৃথক পাহাড়
আমি আর কতোটুকু পারি ?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয় ।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
হৃদয়ের ঋণ
আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর
বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,
একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় মেয়ে গড়ি চারু আনন্দলোক।
দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।
একটি পতাকা পেলে
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
নাম ভূমিকায়
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,–’কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন ঘর বেঁধেছিলে উদ্ধাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ‘ডাস্টবিনে’ ফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায় আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দু’চোখ তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ক তবু সন্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ প্রয়োজন আমার ফুরালো’?
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে
সংগোপনে বলেছে,–’হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই’।
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।
কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠা সেখানেই। ১৯৬৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগ দেন।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান হেলাল হাফিজ। এ ছাড়া যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ, কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননাসহ আরও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।