ডা. ফারজানা রহমান
নাটোরের সিংড়ায় বিএনপির জনসভা মঞ্চে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালিকা ডা. ফারজানা রহমানের বসা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফারজানাকে যুব মহিলা লীগের নেত্রী দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী।
তবে এ দাবির পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ বা কমিটির তালিকা দেখাতে পারেননি। এদিকে ১৯৭৯ সালে ফারজানা রহমানের বাবা আনিছুর রহমান ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।
জন্মসূত্রে বিএনপির পরিবারের সদস্য হলেও ফারজানা সম্প্রতি আলোচিত হয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালিকা হিসেবে। ডা. ফারজানা রহমান যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি বা আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠনের সদস্য কি না, তার অনুসন্ধান করেছে একটি গণমাধ্যম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. ফারজানা রহমানের বাবা আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি সিংড়া দমদমা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আনিসুর রহমানরা ছয় ভাই। ভাইদের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আনিসুর রহমান ১৯৭৯ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তৎকালীন সিংড়া ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে আনিসুর রহমানের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন আনু বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। তিনি বর্তমানে সিংড়া উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক।
ডা. ফারজানার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী বিরোধী হলেও তার চাচাতো বোন বিয়ে করেন আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। পলক ছিলেন সিংড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। পলকের বাবা প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ ছিলেন সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কলেজে পড়া অবস্থায় প্রেমের সম্পর্ক থেকে ২০০২ সালে পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জুনাইদ আহমেদ পলক ও আরিফা জেসমিন কণিকা। কণিকার বাবা আবুল কাশেম (প্রয়াত) মেয়ের ইচ্ছে পূরণে আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হন। পড়াশোনা শেষ করে পলক রাজনীতিতে সক্রিয় হন ও কণিকা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
আরও জানা যায়, ২০০৭ সালে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হানিফ আলী শেখকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ওই নির্বাচন বাতিল হয় এবং ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হানিফ আলী শেখ নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) বাসিন্দা হওয়ায় সিংড়ার আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিবাদ জানায়। তখন সিংড়ায় আওয়ামী লীগে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় উপজেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক পলককে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানালে ২০০৮ সালের নির্বাচনে পলককে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারপর থেকে পলক এ আসন থেকে এমপি ও প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পলক এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনিই এই পরিবারের প্রথম আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কোনো সদস্য।
অপরদিকে, পলকের চাচাশ্বশুর আনিসুর রহমানের মেয়ে ফারজানা ২০১২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২০১৪ সঙ্গে ঢাকা থেকে সিংড়ায় ফিরে এসে একটি বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। পাশাপাশি নিজের প্রতিষ্ঠিত দীপাশা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুস্থ ও অসহায়দের মধ্যে মেডিকেল ক্যাম্প ও বিনামূল্যে ওষুধ-উপকরণ বিতরণ এবং চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ফারজানাকে যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি দাবি করা হলেও অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালের ৪ জুলাই যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা কমিটির সম্মেলনে খাদিজা খাতুন সভাপতি, নীলাবতী হালদার ও ফাইমা খাতুনকে যথাক্রমে সহসভাপতি, জ্যোতি সরকারকে সাধারণ সম্পাদক, হাওয়া খাতুনকে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং শাপলা খাতুন ও শারমিন আক্তারকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য জমা দিতে বলা হলেও তা হয়ে ওঠেনি।
সিংড়া উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি খাদিজা পারভীন বলেন, ‘ডা. ফারজানা যুব মহিলা লীগের কোনো সদস্য বা নেত্রী নন। যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের নাম ওই দিনই (৪ জুলাই ২০২২) ঘোষণা করা হয়েছে। পরে আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি।’
সিংড়ার সাংবাদিক আকতার হোসেন অপূর্ব বলেন, গত এক দশকে এক দিনের জন্যও ডা. ফারজানাকে আওয়ামী লীগ বা এর কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠানে দেখিনি। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হলেও তিনি কোনো দলেরই রাজনীতি করতেন না। তাকে সিংড়ার মানুষ চিকিৎসক হিসেবেই চেনে। তাকে কেবল মেডিকেল ক্যাম্প বা স্বাস্থ্যর সেমিনারেই দেখা যায়।
নাটোর জজকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী আলী আজগর বলেন, আনিসের (ডা. ফারজানার বাবা) পরিবারের সবাই বিএনপির রাজনীতি করে। আনিস সিংড়া ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন আর সভাপতি ছিলেন বিএনপির সাবেক এমপি প্রয়াত আবুল কালাম আজাদ। ফারজানাকে বিএনপি বললে ভুল হবে না বরং তাকে আওয়ামী লীগ হিসেবে চিহ্নিত করলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
ফারজানা যুব মহিলা লীগ নেত্রী মর্মে কোনো প্রমাণ দেখাতে না পারলেও সিংড়া পৌর বিএনপির সভাপতি তায়েজুল ইসলাম বলেন, ‘পলক, দীপু মনি, আব্দুল মোমেনদের সঙ্গে তোলা ছবি তো মিথ্যা না। আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলে ফারজানা এতদূর যেতে পারতেন না।’
ফারজানা রহমান বলেন, ‘যেখানে আমার বাবা বেঁচে আছেন, চাচা উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, আমি নিজে একজন চিকিৎসক, সেখানে আওয়ামী লীগ কেন, কোনো দলীয় পরিচয়ই আমার প্রয়োজন নেই। সেদিন ব্যক্তিগত কাজে চেম্বারে যাওয়ার সময় ওই জনসভাস্থল অতিক্রম করার সময় এলাকার একজন চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী হিসেবে অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বলছিল। একপর্যায়ে মহিলা চিকিৎসক হিসেবে আমাকে বসতে বলায় কিছু সময়ের জন্য প্রথমে মঞ্চের নিচে অবস্থান করি। আমাকে সম্মান জানিয়ে মঞ্চে ডেকে নেয়। একটু পর সেখান থেকে চলে আসি। এর বেশি কিছুই না। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের সঙ্গে তোলা ছবি দেখিয়ে আমাকে আওয়ামী লীগ বানানো হচ্ছে। আমি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গ্রহণকালে এসব ছবি ওঠানো যা বিভিন্ন পত্রিকাতেও এসেছিল। এসব প্রচার করে আমার সম্মান নষ্ট করা হচ্ছে। সূত্র: আজকের পত্রিকা