সিরিয়ায় শাসক হিসেবে আসাদ পরিবারের আধিপত্য স্থায়ী হয় টানা পাঁচ দশকেরও বেশি। ১৯৭১ সালে দেশটির সামরিক নেতা হাফেজ আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন এবং প্রায় তিন দশক দেশ পরিচালনা করেন। ২০০০ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর পুত্র বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। একই সময়ে তিনি বাথ পার্টির নেতা ও সামরিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নেন।
তবে তার শাসনের এক দশক পর, ২০১১ সালে সিরিয়ার জনগণ গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নামলে তিনি কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় সশস্ত্র ও রক্তাক্ত বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধে ।
আন্দোলন বাড়তে থাকলে আসাদ তার বিরোধীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেন এবং দমননীতি জোরদার করেন। ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত হন। আসাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছিল আরব বসন্ত নামে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার সংকটের মূলও নিহিত ওই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই।
দামেস্কের প্রথম বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন রামি জারা। তিনি তখন তার স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে থাকতেন দামেস্কে। কাজ করতেন একটি কোম্পানির ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে।
তিনি বলছিলেন, ‘সিরিয়ায় যে কোনো পরিবর্তন আসবে বা কেউ কোনদিন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলবে - এটা ছিল একটা আকাশকুসুম কল্পনা। এখানে সরকার - আক্ষরিক অর্থেই যেকোনো কিছু করতে পারে। কাউকে অপহরণ করতে পারে, অত্যাচার করতে পারে, মেরে ফেলতে পারে। কেউ এর কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না। এটা অসম্ভব, এটা হতেই পারে না।’
এমনই ছিল তখন সিরিয়ায় বাশার আসাদের শাসনকাল।
রামি জারা বলেছিলেন, ‘সিরিয়ায় জীবন ছিল খুবই আবদ্ধ। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। কিন্তু তার আড়ালে যা চলছিলো তা খুবই বিপজ্জনক এবং ভয়ঙ্কর। সারা দেশের ওপর গোয়েন্দাদের ছিল কঠোর নিয়ন্ত্রণ। লোকে এমন কি প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদের বা তার পিতার নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পেতো। ভয় পেতো সরকারের সাথে তাদের কোন সমস্যার কথা বলতেও। সিরিয়ায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত।’
সিরিয়ায় এর পরের মাসগুলোতে অসংখ্য শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সহিংস পন্থায় দমন করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার। হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়, নির্যাতন করা হয়। অনেকে নিখোঁজ ও গুম হয়।
এর কিছকাল পর সেনাবাহিনীর কিছু নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা সামরিক বাহিনী ছেড়ে দিয়ে এক সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। এরপর থেকেই দেশটিতে যুদ্ধ চলছে।
যদিও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদ কখনোই বিজয় নিশ্চিত করতে পারেননি, কিন্তু তারপরও তিনি তার সমর্থকদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘু আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন।
অবশেষে আজ রোববার (৮ ডিসেম্বর) বিদ্রোহীদের সশস্ত্র অভিযানের মুখে দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন বাশার আল-আসাদ, অবসান হয় আসাদ পরিবারের সুদীর্ঘ ৫৩ বছরের শাসনের।
ক্ষমতার উত্তরাধিকার হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করা এই ব্যক্তি একসময় সংস্কারের প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন একজন স্বৈরশাসক। তার শাসনামল চিহ্নিত হয়েছে গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য। অবশেষে, বিদ্রোহীদের চাপে এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের দুর্বলতায় তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হতে হয়েছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বলছেন, সিরিয়া এখন আসাদ থেকে মুক্ত। এর আগে সিরিয়ার দুইজন সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, আসাদ প্লেনে করে দামেস্ক ছেড়েছেন। তবে তিনি ঠিক কোথায় গেছেন- সেই সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি।
ফ্লাইটরাডার ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ার একটি বিমান উড্ডয়ন করেছে। এরপর বিমানটি সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে যায়। তবে আচমকা বিমানটি ইউ-টার্ন নিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য উল্টো দিকে উড়ে যায় এবং ম্যাপ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
তবে বিমানটিতে কারা ছিলেন তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে পারেনি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
সিরিয়ার বিরোধীরা বলছেন, স্বৈরশাসক আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তারা আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে সশস্ত্র বিরোধীরা বলেছেন, স্বেচ্ছাচারী শাসক আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আমরা দামেস্ককে বাশার আল-আসাদ থেকে মুক্ত ঘোষণা করছি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দামেস্কের প্রধান স্কয়ারে হাজার হাজার লোক গাড়িতে করে এবং পায়ে হেঁটে এসেছেন। তারা হাত নাড়ছেন এবং স্বাধীনতা বলে স্লোগান দিচ্ছেন।
বিদ্রোহীরা বলছেন, আমরা সিরিয়ার জনগণের সঙ্গে আমাদের বন্দীদের মুক্ত ও তাদের শিকল ভাঙার এবং সেদনায়া কারাগারে অবিচারের যুগের সমাপ্তি ঘোষণা করার সংবাদ উদযাপন করছি।
এরই মধ্যে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। দামেস্কের রাস্তায় রাস্তায় এখন বিজয়োল্লাস, উৎসবের আমেজ যেন এক নতুন ও স্বাধীন সিরিয়া। তারা উল্লাস প্রকাশের পাশাপাশি ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগানও দিচ্ছেন।
তবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আন্দোলনকারী সশস্ত্র বিদ্রোহীরা।